কোভিড-১৯ সদৃশ নতুন আরেকটি রোগ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, বাংলাদেশেও শনাক্ত
গেল বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম ধরা পড়ে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস। যা ইতোমধ্যে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এ রোগের সংক্রমণের মধ্যেই বিশ্বে আরেকটি নতুন এবং বিরল রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই রোগটির নাম মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (এমআইএস-সি) অথবা পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (পিএমআইএস)। এ রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি বলে জানিয়েছেন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সম্প্রতি বাংলাদেশেও এ রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে। রোগী দুজন ছিল, একজন সাড়ে ৩ মাস বয়সী একটি মেয়ে এবং অপরজন ২ বছর ২ মাস বয়সী একটি ছেলে। প্রথমবারের মতো এ রোগের চিকিৎসা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পুরো ইউরোপ থেকে ক্লিনিক্যাল প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, কোভিড-১৯ সদৃশ নতুন আরেকটি ক্লিনিক্যাল সিনড্রোম রয়েছে যাতে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই নতুন ও বিরল রোগটির নাম মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (এমআইএস-সি) অথবা পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (পিএমআইএস)। এই রোগে শরীরের একাধিক অঙ্গে রক্তনালীর প্রদাহ সৃষ্টি হয়, এবং তা হয় অসম্ভব দ্রুত গতিতে। এতে রক্তের প্রবাহ কমে গিয়ে হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের মতো একাধিক অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এর বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকটা কাওয়াসাকি ডিজিজ ও টক্সিক শক সিনড্রোম-এর মতো।
জানা গেছে, এ রোগ প্রথম ধরা চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল যুক্তরাজ্যে এবং পরে একে একে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতেও এটি দেখা যায়। বাংলাদেশে এটি প্রথম শনাক্ত করা হয় ১৫ মে এবং পরে ২৭ মে এভারকেয়ার হাসপাতালে।
এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালের চিকিৎসক এম কামরুল হাসান ও শিশু হৃদরোগ বিষয়ক কনসালটেন্ট তাহেরা নাজরিন এবং শিশু বিভাগের চিকিৎসকগণ ও শিশু ইনটেনসিভ কেয়ার টিমের সহযোগিতায় রোগটি নির্ণয় করেন ও সফলভাবে এর চিকিৎসা করেন। রোগী দুজন ছিল সাড়ে ৩ মাস বয়সী একটি মেয়ে ও ২ বছর ২ মাস বয়সী একটি ছেলে। দুজন শিশুরই যথাক্রমে ৫ ও ৭ দিন ধরে ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফাররেনহাইটে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর ছিলো, তার সাথে ছিলো ডায়রিয়া, চোখ ও ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়া এবং পায়ের হালকা ফোলা ভাব। এর সাথে তাদের হৃদপিন্ডে রক্ত সরবরাহকারী করোনারি রক্তনালীও আক্রান্ত হয়ে ফুলে গিয়েছিলো। বয়সে বড় শিশুটির খিঁচুনিও হয়েছিলো এবং সেই সাথে ছিলো হার্ট বড় হয়ে যাওয়া ও হার্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস। আরটি-পিসিআর টেস্টে এই শিশুটির কোভিড-১৯ পজিটিভও দেখায়। অন্য রোগীটির রেজাল্ট যদিও নেগেটিভ আসে, কিন্তু কিছুদিন পরই তার পরিবারের সকল সদস্যদের করোনা শনাক্ত হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ছেলে শিশুটির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)-তে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। দুজন শিশুকেই গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিলো এবং তাদেরকে ইন্ট্রাভেনাস ইমুনোগ্লোবুলিন (আইভিআইজি) দেয়া হয়েছিলো। ইমুনোগ্লোবুলিন (আইভিআইজি) হচ্ছে অ্যান্টিবডির মিশ্রণ, যা সুস্থ ডোনারের রক্তের প্লাজমা েেক তৈরি করা হয়; এটি সংক্রমণ ও প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। এই চিকিৎসায় তাদের অবস্থা স্থিতিশীল ও ক্রমে উন্নতি হলে পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেয়া হয় এবং নিয়মিত ফলোআপে রাখা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর পরামর্শমতে, কোভিড-১৯ ও এমআইএস-সি একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত। পজিটিভ অ্যান্টিবডিগু পরীক্ষা করে এটি প্রমাণিত যে, এমআইএস-সি-তে আক্রান্ত অসংখ্য শিশু অতীতে কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলো; এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণও ছিলো না। তবুও, শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাসটি সক্রিয় থাকতে পারে এবং একই সাথে তার মধ্যে এমআইএস-সি এর লক্ষণগুলোও দেখা যেতে পারে।
হাসপাতালের শিশুরোগ বিষয়ক সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ এম কামরুল হাসান জানান, এই মহামারী চলাকালীন সময়ে অভিভাবকদের উচিৎ তাদের সন্তানদের এই ক্ষতিকর ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি এই নতুন ও বিরল রোগের ব্যাপারেও সর্তক থাকা। রোগটি কীভাবে বেড়ে উঠে, ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং কীভাবে এই রোগের সংক্রমণ থেকে আমাদের সন্তানরা বাঁচতে পারে সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।
এমআইএস-সি-এর লক্ষণসমূহ কী কী?
- প্রচণ্ড জ্বর থাকবে, যা ৩-৫ দিনের বেশি স্থায়ী হতে পারে
- পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া ও বমি-ভাব হবে
- চোখ লাল হয়ে যাওয়া
- ঠোঁট, জিহ্বা লাল হয়ে যাওয়া
- চামড়ায় ফুসকুড়ি
- ত্বকের রং পরিবর্তন, ত্বকের নিচে রক্ত জমার লক্ষণ
- বুকে ব্যথা অনুভূত হবে
- শ্বাসকষ্ট
- ক্লান্ত লাগবে
- শিশুদের ক্ষেত্রে খাওয়াদাওয়ার প্রতি অনীহা
এমআইএস-সি-তে কারা আক্রান্ত হয়?
শিশুদের মধ্যে এই রোগটি বেশি দেখা গেলেও অল্প বয়স্ক তরুণরাও এতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই হিসাবে, ২১ বছরের কম বয়সী শিশু ও কিশোররা এতে আক্রান্ত হতে পারে। কোভিড-১৯-এর সাথে সম্পর্কিত থাকার সম্ভাবনার জন্য কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিদের এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে। তবে, এমআইএস-সি রোগীদের দেহে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির উপস্থিতি বা কোভিড-১৯ ডায়াগনোসিস করার জন্য কোনো উপসর্গ থাকবেই তা জরুরি নয়।
এমআইএস-সি এর কি চিকিৎসা সম্ভব?
হ্যাঁ, এর চিকিৎসা সম্ভব এবং উপরে বর্ণিত লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনোটি শিশু বা কিশোরদের মধ্যে দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এই চিকিৎসা বাড়িতে করা সম্ভব নয়, কারণ এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন হয়; এমনকি আইসিইউ-এরও প্রয়োজন হতে পারে। তাই, অভিভাবকদের অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে এবং তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলছে এমন লক্ষণ খেয়াল রাখতে হবে।
এমআইএস-সি সংক্রমণ হওয়া থেকে বাচ্চাদের কীভাবে দূরে রাখবেন?
কোভিড-১৯-এর সাথে সম্পর্কিত তাই, শিশুদের এমআইসিএস-সি হওয়া থেকে বাঁচানোর সর্বোত্তম উপায় হলো তাদের সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা।
এটি নিশ্চিত করতে অভিভাবকগণ যা করতে পারেন:
- সন্দেহযুক্ত বা নিশ্চিত কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা
- মুখে মাস্ক পরা (২ বৎসর বয়সের বেশি)
- সবার সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা
- কিছুক্ষণ পরপর হাত ধোয়া এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কোনো শিশুর মধ্যে যদি এমআইএস-সি-এর লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ তার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং কোনো হাসপাতালে স্থানান্তর করাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি চিকিৎসা না করা হয় তবে রোগীর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে; এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
হাসপাতালের চিকিৎসক এম কামরুল হাসান জানান, এই রোগ সম্পর্কে জ্ঞান এখনও সীমিত কিন্তু বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা প্রতিয়িত নমুনা সংগ্রহ করতে ও এটিকে আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যা রোগটি প্রতিরোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসার উপায়কে উন্নত করতে সহায়তা করবে, যেনো আক্রান্ত রোগীরা আরও ভালো ফলাফল পান।