করোনা হাসপাতালে ১৯ দিনের ভয়াবহ চিত্র, বাইরে দোকানে যেতেন রোগী
করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ১৯ দিন ছিলেন গণমাধ্যমকর্মী খলিলুর রহমান। গত ২৪ এপিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। তবে এখনো ভুলতে পারছেন না সেই হাসপাতালের তিক্ত অভিজ্ঞতা। এমনকি চোখের সামনে দেখেছেন চারটি মৃত্যু। ফলে হাসপাতালের প্রতিদিন কেটেছে চরম আতঙ্ক আর ভয়ে। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা ওই আতঙ্ক আরও বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় খাবার-ওষুধ আনতে বাইরের দোকানে যেতেন তিনি।
‘হাসপাতালে গিয়ে প্রথমে একটি ধাক্কা খেয়েছি। যে রুমে লাশ রয়েছে সেই রুমেই আমাকে থাকার জন্য পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলে পারতো ওই লাশটি রুমের বাইরে রাখতে। পরে শুনলাম লাশটি ৩ ঘণ্টা ধরে সেখানে ছিল কেউ দেখতেও আসেনি। এরপর তারাই লাশটি কোলে করে নিয়ে যায়।’- বলছেন খলিলুর রহমান। এভাবে চোখের সামনে চার মৃত্যুর বর্ণনা দেন তিনি।
তিনি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় রুমের সবগুলো বেডেই রোগী চলে আসে। কোনো বেডেই ফাঁকা ছিল না। আর তার রুমেই মারা যান আরও চারজন। তারা তার আশেপাশের বেডেই ছিলেন। প্রথমজনের মৃত্যু এখনো তার চোখে ভাসছে- ‘আমার বেড নম্বর ছিল ৩৬। আমার পাশের ৩৭ নম্বর বেডে একজন হিন্দু রোগী দেওয়া হয়েছে। তার স্বজনরা এসে রেখে গেছে আর খোঁজ নিতে আসেনি। তিনি সব সময়ই চিৎকার চেঁচামেচি করতেন, আহাজারি করতেন। শ্বাস নিতে পারতেন না। কোনো ডাক্তারও দেখতে আসতেন না। পরে আমরাই গিয়ে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসি। কিন্তু কীভাবে তা লাগাতে হয় আমরা যারা, রোগী ছিলাম কেউই জানতাম না।’
‘২৫ তারিখ সকাল ৮টার দিকে তিনি ঘুম থেকে উঠে একাই ব্রাশ করে এসে ঘুমিয়ে ছিলেন। সেই যে ঘুমালেন, আর জেগে উঠলেন না। আমরা অন্য রোগীরা দূর থেকে দেখি তিনি কোনো নড়াচড়া করছেন না। ওভাবেই মারা গেছেন তিনি। লাশের পাশে বসেই আমরা ৬ জন রোগী ছিলাম সেই রুমে সবাই খাওয়া-দাওয়া করেছি। কি করবো ওষুধ তো খেতে হবে।’
‘এই ৬ জনের মধ্যে আমরা তিনজন ছিলাম যুবক। আর বাকি তিনজন বৃদ্ধ। তারা এমন মৃত্যু ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সেই দিন দুপুর ২টা পর্যন্ত লাশটি আমাদের রুমেই ছিল। ২টার দিকে ভাগ্যক্রমে হাসপাতালের একজন সহকারী পরিচালক ভিজিটে আসেন। তাকে আমরা বিষয়টি জানালে তিনি লাশটি রুম থেকে বের করে নেওয়ার ব্যবস্থা নেন।’
‘চতুর্থদিন ঘটে দ্বিতীয়মৃত্যু। তিনি বৃদ্ধলোক ছিলেন। যিনি এতটাই অসুস্থ যে কথাও বলতে পারেন না। তারও কোনো স্বজন হাসপাতালে খোঁজখবর নিতে আসে না। ওইদিন রাত ২টার দিকে দেখি সেই বৃদ্ধ লোকটি বেডে থেকে নিচের দিকে মাথা ঝুলিয়ে আছে। পরে আমরা অন্য রোগীরা গিয়ে দেখি তিনি মরে পড়ে আছেন। তখন নার্সকে ডাকি, ডাক্তারকে ডাকি কেউই রুমে আসে না।’
‘তখন আমরা তার ঝোলানো মাথাটা বেডের ওপরে তুলে ঢেকে রাখি। যাতে অন্য বৃদ্ধ রোগীরা দেখে ভয় না পান। কারণ এমন অবস্থায় কোনো লাশ দেখলে যে কেউ স্ট্রোকও করতে পারে। পরে বেডটাই আমরা ঠেলে ঠেলে রুম থেকে বের করে বাইরে রাখি। এরপর একজন ওয়ার্ড বয়কে অনুরোধ করি লাশটা সেখান থেকেও সরাতে।’
‘এভাবে চোখের সামনে বিদায় নিলেন তৃতীয়জন। পঞ্চমদিনে আরেকজন বৃদ্ধ লোক ছিলেন তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। তার সঙ্গে অবশ্য স্বজন ছিল। ওই রোগীর ডায়াবেটিসের সমস্যা ছিল। ওনার ছেলেরা তাকে পপুলারে নিয়েছিল। পরে সেখানে থেকে তাকে মুগদা এনে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি আগেও একবার স্ট্রোক করেছিলেন বলে জানিয়েছে তার ছেলেরা। সেই রাতেই তিনি মারা গেলেন।’
‘আর ষষ্ঠদিন মারা গেলেন আরেক করোনা রোগী। মারা যাওয়ার আগে তার প্রচুর ডায়েরিয়া হয়েছিল। তার সাথেও ছেলেরা ছিল। তাকে স্যালাইন খাওয়াতো। কিন্তু তিনি অনেক মোটা ছিলেন, তাই তাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে অনেক কষ্ট হতো। পরে ওই রাতে তিনিও মারা গেছেন। পরে তার লাশ নিয়ে যায় সন্তানরা।’
‘করোনা রোগী হয়েও গিয়েছি দোকানে’: হাসপাতালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে খলিল বলেন, ‘খাওয়ার জিনিস এবং ওষুধ কিনতে বাধ্য হয়ে আমি নিজেই হাসপাতালের বাইরে গিয়েছিলাম। কি করবো, আসলে কিছুই করার ছিল না। বাঁচতে হলে প্রয়োজনীয় খাবার তো কিনতেই হতো।’
তিনি বলেন, ‘বাইরে যাওয়ার সময় আমি মুখে ডাবল মাস্ক এবং পিপিই পড়েছিলাম। যাতে আমার মাধ্যমে অন্য কেউ আক্রান্ত না হয়। দোকানে জিনিসপত্র কেনার সময় সাবধানে ছিলাম যাতে কেউ কাছে না আসে। আবার বুঝতেও দেইনি আমি করোনা রোগী। কারণ এ কথা জানলে কেউ দোকান থেকে কিছু বিক্রি করবে না আমার কাছে।’
হাসপাতাল থেকে বাইরে গেলেও কেউ বাধা দেয়নি কিনা-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘করোনা রোগী শুনলেই আনছার-স্টাফরা পালায়, বাধা দেবে কে! অবশ্য তারাও জানেন, দরকারি জিনিসপত্র কিনতেই অনেকে বাইরে যায়।’