১৮ মে ২০২০, ০৯:৪৬

পশ্চিমবঙ্গে ওষুধের তীব্র সংকট

লকডাউনের গোড়া থেকে ওষুধের আকাল পশ্চিমবঙ্গে। লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছে এখনো। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অনেক জীবনদায়ী ওষুধ সহজলভ্য নয়। করোনা সংক্রমণের কারণে লকডাউন চলতে থাকায় সব শিল্পেই তার প্রভাব পড়েছে। ওষুধের ক্ষেত্রেও যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা এখনো পুরো কাটেনি। ওষুধ উৎপাদন থেকে সরবরাহ এবং শেষে ক্রেতার হাতে পৌঁছানো, কোনো পর্যায়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি।

লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর সব খুচরো দোকান ও স্টকিস্ট বা মজুতকারীদের কাছে পর্যাপ্ত ওষুধ ছিল৷ কিন্তু, ওষুধ পাওয়া যাবে না, এই আশঙ্কায় বেশি পরিমাণে কিনতে শুরু করে সাধারণ মানুষ৷ ওষুধের দোকানের সামনে লম্বা লাইন পড়ে যায়৷ অনেকেই প্রয়োজনের থেকে বেশি ওষুধ কিনতে থাকায় কৃত্রিম অভাব তৈরি হয়৷ খুচরো দোকানে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো ঘরে ঘরে প্রয়োজনীয় ওষুধ ফুরিয়ে যায়৷ এর ফলে ওষুধের আকাল তৈরি হয়৷

লকডাউন কার্যকর হওয়ায় কলকাতার ওষুধের সবচেয়ে বড় বাজার বাগরি মার্কেটের মেহতা বিল্ডিং-এ তালা পড়ে৷ শহরের সব খুচরো দোকানের ৮০ শতাংশের চাহিদা পূরণ করে এই বাজার৷ এই পরিস্থিতিতে গাড়ি চলাচলেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়৷ ফলে খুচরো দোকানে ওষুধের জন্য ক্রেতার লাইন লম্বা হতে থাকে, কিন্তু ডিস্ট্রিবিউটার-দের কাছ থেকে ওষুধের সরবরাহে বাধা তৈরি হয়৷ এর ফলে ওষুধের যে সংকট তৈরি হয় তা এখনো পুরোপুরি কাটেনি৷ পরে পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিচয়পত্র দেওয়া হয় গাড়িচালকদের৷ ওষুধের গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়৷ বাগরিতে কিছু দোকান খুলেছে বটে, তা সত্ত্বেও সর্বত্র ওষুধ এখনো সহজলভ্য নয়৷

ক্যান্সার থেকে ভাইরাস সংক্রমণ, বিভিন্ন রোগের ওষুধ পেতে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে৷ কলকাতার এয়ারপোর্ট এলাকার বাসিন্দা নূপুর সরকারের প্রয়োজন আরটাপেনাম ইঞ্জেকশন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চিকিৎসক তিন সপ্তাহ ইঞ্জেকশন নিতে বলেছেন৷ কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে ২-৩টির বেশি পাচ্ছি না৷ ফলে যে কোনো দিন ইঞ্জেকশন বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷’’

করোনা সুরক্ষা বিধি অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হচ্ছে৷ এর ফলে বিভিন্ন শিল্পের উৎপাদন মাসখানেক বন্ধই ছিল৷ কোথাও উৎপাদন শুরু হয়েছে, কোথাও এখনো বন্ধ৷ হিমাচল প্রদেশে ওষুধ তৈরির অনেক কারখানায় উৎপাদন থমকে গিয়েছিল৷ এর ফলে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি৷ একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী সঞ্জয় সাহা বলেন, ‘‘বহু কারখানা চালানো সম্ভব হয়নি গোড়ায়৷ এখন উৎপাদন শুরু হয়েছে৷ তবে ৩০-৪০ শতাংশ কর্মী নিয়ে কাজ চলছে৷ একটা বড় সংস্থার সঙ্গে ২০ হাজারের মতো মানুষ যুক্ত৷ এই শিল্পও যথেষ্ট উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে৷’’

ক্যানসার, পার্কিনসন্স, স্ত্রী রোগ, থ্যালাসেমিয়া, কিডনি ও হৃদরোগের ক্ষেত্রে যেসব ওষুধ জীবনদায়ী, তার জোগান চাহিদার তুলনায় কম৷ সোয়াইন ফ্লু-র ওষুধ ট্যামি ফ্লু, কালাজ্বরের মিলটেফোসিন তো বটেই, হেপারিন, অ্যাসপিরিন, র‍্যানিটিডিন গ্রুপের ওষুধ অমিল অনেক জায়গায়৷ এমনকী ঘরে ঘরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি বা ইনসুলিন-এর রিফিল ইঞ্জেকশন চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে না৷ বারাসতের বৃদ্ধা অমিতা নন্দী বলেন, ইনসুলিন বন্ধ করতে একেবারেই নিষেধ করেছেন চিকিৎসক৷ কিন্তু, এলাকার দোকানে পাচ্ছি না৷ খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ডিস্ট্রিবিউটার-দের কাছেও নেই৷ বেশি দাম দিতে চাইলেও লাভ হচ্ছে না৷ ফলে ওষুধ না নিয়েই চলতে হচ্ছে৷ এ বিষয়ে সার্ভিস ডক্টর্স ফোরাম-এর পক্ষে ডা. স্বপন বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোভিডের দিকে আমরা সব নজর কেন্দ্রীভূত করেছি৷ এর ফলে নন-কোভিড রোগের ক্ষেত্রে একটু ঢিলেমি এসেছে৷ সে কারণে ওষুধের সরবরাহে ঘাটতি হয়েছে৷ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে৷ তবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি৷''

এখন অনেকেই অনলাইন মার্চেন্টের কাছ থেকে ওষুধ কেনেন৷ তাদের কাছে ওষুধের চাহিদা একলাফে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে৷ কিন্তু, যে মূল কেন্দ্রে ওষুধ প্যাকিং করা হয়, সেখানে কর্মীরা আসতে পারছেন না৷ এর ফলে যেখানে একদিনে ওষুধ বাড়িতে পৌঁছে যেতো, সেখানে পাঁচদিন পর্যন্ত সময় লাগছে৷ প্রশাসনের কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে, সুরক্ষা বিধি অনুযায়ী গ্লাভস, মাস্ক পরে বাড়ি বাড়ি ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছেন অনলাইন সংস্থার কর্মীরা৷ যদিও ইনসুলিনের মতো অনেক ওষুধের অর্ডার দিতে গিয়ে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন-এর মাধ্যমে অনলাইন স্টোর-এ এসে হতাশ হচ্ছে সাধারণ মানুষ৷