করোনা: যে কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক অবস্থায়
রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা সোহানা ইয়াসমিনের মধ্যরাতে পেটে ব্যথা শুরু হওয়ার পর তিনটি হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি। পরে ডাক্তার বোনের অনুরোধের পরে একটি হাসপাতালে ভর্তি হতে সক্ষম হন। প্রচণ্ড বেদনা নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকতে হয়েছে।
তিনি বলছেন, ‘'জ্বর ও পেটে ব্যথার জন্য একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখিয়েছিলাম। তিনি কয়েকটি টেস্ট করতে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে করোনাভাইরাসের টেস্টও আছে। কিন্তু মধ্যরাতে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়লে আমার পরিবারের লোকজন প্রথমে গ্রিনদের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান।’
‘কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা সবাই কোয়ারেন্টিনে আছেন জানিয়ে তারা ভর্তি করতে পারবেনা বলে। এরপরে আমার সেই চিকিৎসকের হাসপাতালে যাওয়া হয়। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উনিও দেখতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।’
‘এরপর আমার চিকিৎসক ছোটবোন বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগের পর, মহাখালীর একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার ডাক্তার বোন সবাইকে অনুরোধ করার পর তারা ভর্তি করতে রাজি হয়।’ এরকম ভোগান্তির শিকার তিনি একাই হননি। চিকিৎসা সেবা নিয়ে অনেকেই ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতা নিয়ে বরাবরই অভিযোগ থাকলেও, করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিস্তার লাভের পর থেকেই দেশটির স্বাস্থ্য অবস্থা যে কতটা নাজুক, সেই চিত্রটি ফুটে উঠেছে। একদিকে যেমন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালগুলো ঠিকভাবে সেবা দিতে পারছে না, অন্যদিকে অন্যান্য জটিলতার রোগীরাও চিকিৎসা পেতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি সেই তালিকায় রয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোও।
সম্প্রতি মারা যাওয়া একজন অতিরিক্ত সচিবের চিকিৎসক কন্যা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, কিডনির সমস্যা নিয়েও একের পর এক হাসপাতাল ঘুরে তার পিতাকে ভর্তি করাতে পারেননি। শেষপর্যন্ত যখন তারা বিফল হয়ে রোগীকে নিয়ে বাসায় এসে বসে রয়েছেন, তখন একজনের তদবিরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেন। কিন্তু আইসিইউ সুবিধা না পাওয়ার কারণে তার পিতা মারা যান।
বিবিসির অনুসন্ধানে চিকিৎসা সেবা পাওয়া নিয়ে এরকম অনেক রোগীর ভোগান্তি, হাসপাতালে ভর্তি নিয়ে হয়রানির নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। করোনাভাইরাস নিয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তারা হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার চরম দুরবস্থার চিত্র বর্ণনা করেছেন। দেশের জেলা বা উপজেলা শহরে চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার অভিযোগ বেশ পুরনো। সেখানে ভালো চিকিৎসক থাকেন না, হাসপাতালগুলোয় সরঞ্জামাদির অভাবের অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু এখন ঢাকা ও জেলা শহরগুলোর হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসক, সেবিকা ও টেকনিশিয়ানের অভাব, আইসিইউ ও মেডিকেল সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততার নানা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশজুড়ে যে হাজার হাজার বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক গড়ে উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে এই সংকটের সময় চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে রাখার অভিযোগও রয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিযোগ, তাদেরকেও অনেক প্রতিকূলতা এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। মানসম্পন্ন মাস্ক ও পিপিই না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে করোনাভাইরাস সংকটের শুরু থেকেই। এ নিয়ে সামাজিক অনেক চিকিৎসক তাদের অভিযোগ তুলে ধরেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হতে চললেও, স্বাস্থ্য খাতের এরকম অবস্থার কারণ কি? চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহবায়ক ড. রশিদ-ই মাহবুব এজন্য স্বাস্থ্যখাতে দরকারি সংস্কার না হওয়াকে দায়ী করছেন।
তিনি বলছেন, ‘সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এটা বিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু সংস্কার হয়নি। জনসংখ্যার হিসাবে আমাদের যে চাহিদা, তার জন্য যে সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার না করেই এটা বিবর্তিত হয়ে আসছে। সেটাও হচ্ছে যার যার মর্জি মতো।’
‘দ্বিতীয় হলো, এটার অর্থায়ন নিয়ে একটা সমস্যা আছে। সরকারি অর্থায়ন যেটা দেয়া হয়, সেটা প্রতিনিয়ত কমছে। কমতে কমতে এখন যেই পর্যায়ে চলে আসছে, তাতে বেতন ভাতা হয় আর কিছু অবকাঠামো তৈরি, যন্ত্রপাতি কেনার খরচ হয়। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় যতটা অবকাঠামো তৈরি হয়, যন্ত্রপাতি কেনায় যতটা দুর্বৃত্তায়ন হয়, কিন্তু জনগণের চিকিৎসার ট্রেন্ডটা কি হবে, সেটা ঠিক করা হয়নি।’
‘যেহেতু জন চাহিদা আছে, তখন একটা বিকল্প বেসরকারি ব্যবস্থাপনা চলে আসছে। কিন্তু চিকিৎসার নামে বেশিরভাগই সেখানে অর্থ উপার্জনের কাজটা হয়।’ তিনি জানান, ২০০০ সালে ও ২০১১ সালে দুইটি স্বাস্থ্য নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর তেমন একটা বাস্তবায়ন হয়নি। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।
‘এখানে রাজনীতির একটা জায়গা আছে, আমলাদের একটা ব্যাপার আছে আর আছে কর্মী বাহিনী। তিনটার মধ্যে সমন্বয়টা হয়নি। সেই সমন্বয় না হওয়ায় এই গাড়ি চলে না। যে যার মতো কাজ করছে আর এখন এটা স্থবির হয়ে পড়ে আছে।’ বলছেন ড. মাহবুব।
তিনি বলছেন, সংস্কার এবং জবাবদিহিতা আগে নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে কর্মীদের ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও পরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসক অনেক থাকলেও, দক্ষ টেকনিশিয়ান নেই। পরিকল্পনা না থাকলে দেখা যাবে, অনেক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আছে, কিন্তু অ্যানেসথেসিয়া দেয়ার লোক নেই।
২০১৯-২০২০ সালের চলতি বাজেটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থ মূল্যে যার পরিমাণ ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ডে ব্যয় করা হয় জিডিপির ৯ শতাংশ।
জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্যা প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপির বিচারে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়া হয় বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বরাদ্দও পুরোপুরি ব্যয়িত হয়না বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
স্বাস্থ্য খাতের সংকট সমাধানে তারা বরাদ্দ ও ব্যয় সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠেলে সাজানোর পরামর্শ দিচ্ছেন ড. রশিদই মাহবুব। সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিযোগ, তাদেরকেও অনেক প্রতিকূলতা এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামলাতে সম্প্রতি জরুরি ভিত্তিতে দুই হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ হাজার সেবিকা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আইসিইউ ও হাসপাতাল শয্যা বাড়ানোর কাজও শুরু হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনো ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসার বেহাল চিত্র খুব একটা পাল্টায়নি।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল বিভাগের পরিচালক আমিনুল ইসলাম বলছেন, এসব সমস্যা তারা সমাধানের চেষ্টা করছেন। তিনি বলছেন, ‘এসব সমস্যা বা চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সবগুলো চ্যালেঞ্জই তাদের জানা রয়েছে এবং আমরা প্রতিদিনই চেষ্টা করছি কীভাবে এগুলো অ্যাড্রেস করা যায়। অনেক সমস্যা এর মধ্যেই সমাধান করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, বাকি সমস্যাগুলোও খুব তাড়াতাড়ি আমরা সমাধান করতে পারবো।’
কিন্তু এতদিন ধরে এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়নি কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছেন, যেভাবে স্বাস্থ্যখাতের সংস্কার হওয়া দরকার, সেইভাবে সংস্কারটা হয়নি। এখানে পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে।
‘গতবছরের শেষের দিকে পদ্ধতিগত সংস্কারের কাজ আমরা শুরু করেছি। আমরা মনে করি, এই পদ্ধতিগুলোকে যদি আমরা ভালোভাবে সংস্কার করতে না পারি, তাহলে কিন্তু আলটিমেটলি লংটার্মে যে স্বাস্থ্যখাতের কথা আমরা চিন্তা করি, সেটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। সেই সংস্কারের আমরা কাজ শুরু করেছি। মাঝখানে করোনাভাইরাস চলে এসে আমাদের প্রসেসটা একটু থমকে গেছে।’
করোনাভাইরাসের পরিস্থিতির অবসান হলেও তারা আবার সেটার কাজ শুরু করবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।