করোনা: বিশ্বের যেসব দেশ লকডাউন তুলে নিল
মহামারি করোনাভাইরাস গত কয়েক মাস প্রায় পুরো বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। এ মহামারি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হিসেবে সারা বিশ্বে শুরু হয় লকডাউন। আর এতে জীবন রক্ষা পেলেও থমকে গেছে মানুষের জীবিকা। ধসে পড়ছে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি। তাই পরিস্থিতি বুঝে ধীরে ধীরে অবরুদ্ধ অবস্থা শিথিল করছে বিভিন্ন দেশ।
লকডাউনে সম্ভব হয় সংক্রমণ কমানো। তাতে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ সিদ্ধান্ত নেয় লকডাউন তুলে স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার। তাই পরিস্থিতি বুঝে কিছু দেশ অবরুদ্ধ অবস্থা শিথিলও করে। এতে আবার চলতে শুরু করল কল-কারখানা আর খুলতে শুরু করল দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সারা বিশ্বের যেসব দেশ লকডাউন শিথিল করেছে এদের মধ্যে রয়েছে-
চীনের উহানবাসী
চীনের উহানে শুরু প্রথম করোনাভাইরাসের। ১০ জানুয়ারি করোনাভাইরাসে প্রথম রোগীর মৃত্যু হয়। ভাইরাসটির দ্রুত বিস্তারের কারণে ১ কোটি ১০ লাখ লোকের শহরকে অবরুদ্ধ করা হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। লোকজনকে ঘরবন্দী বা কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয় দিনের পর দিন। সরকারি সূত্র মতে, শহরের প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে মারা যাওয়া মানুষের ৮০ শতাংশই উহান শহরের। এখানে মারা যায় আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। দুই মাসেরও বেশি সময় অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল উহানবাসী। অবশেষে হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে কয়েকদিন আগে লকডাউন উঠেছে। ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে পুরো এলাকা। খুলে দেওয়া হয়েছে যানবাহন। কল-কারখানা, দোকানপাট এবং রেস্তোরাঁগুলো খুলতে শুরু করে। মিলেছে অন্যান্য শহর থেকে উহানে আসা যাওয়ার অনুমতি। তবে তা কেবল কয়েকটি নিয়ম মেনে। যেমন- চেক পয়েন্টগুলোয় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। চীনের কর্তৃপক্ষ জানায়, স্থানীয় বার ও রেস্তোরাঁগুলোর টেবিলগুলো কমপক্ষে এক মিটার দূরে স্থাপন ও জীবাণুমুক্ত করার নিয়ম মেনে চলা উচিত।
ইরান
দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ না পেরোতেই দেশজুড়ে বিধিনিষেধ ধীরে ধীরে তুলে নিতে শুরু করল ইরান সরকার। গত ৪ এপ্রিল দেশটির অধিকাংশ সরকারি অফিস খুলে দেওয়া হয়। এছাড়াও জরুরি প্রয়োজনের আওতার বাইরে থাকা সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় দেশটির প্রশাসন। এর আগে যদিও রাজধানী শহর তেহরানের বাইরে সব সরকারি অফিস খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে কর্মীদের উপস্থিতির সংখ্যা ছিল মাত্র দুই- তৃতীয়াংশ। ইরান সরকার বাকিদের ‘ওয়ার্ক এট হোম’ বা বাড়ি থেকে কাজ করার পরামর্শ দেয়। তেহরানে যেসব ব্যবসয়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোও দ্রুত খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে তার জন্য সরকারের কাছে নাম নথিভুক্ত করিয়ে সামাজিক দূরত্বের শর্ত মেনে চলতে হবে। আগামীতে তেহরানের সরকারি অফিসগুলোও দুই-তৃতীয়াংশ কর্মী নিয়ে খোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। মূলত অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান সরকার। দেশে করোনা সংক্রমণ মারাত্মক আকার নিলেও পুরোপুরি লকডাইনে রাজি নয় ইরান প্রশাসন।
ইতালি
করোনাভাইরাসে ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ইতালি। সংক্রমণ আর মৃত্যু এড়াতে লকডাউন ঘোষণা করে ইতালির সরকার। কেবল জরুরি নিত্যপণ্য কেনা ছাড়া বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এতে অর্থনীতি স্থবির হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটি কাটাতেই এখন লকডাউন শিথিলের কথা ভাবছে সরকার। যার ফলস্বরূপ, টানা পাঁচ সপ্তাহ পর লকডাউন শিথিল করেছে ইউরোপের দেশ ইতালি। খুলছে বই, মণিহারি ও শিশুদের জামা-কাপড়ের দোকান। কম্পিউটার সরঞ্জাম ও কাগজের দোকানও খুলে দিয়েছে প্রশাসন। তবে যেসব শহরে করোনা পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয় সেগুলোতে জারি রাখা হয়েছে লকডাউন। আবার দেশটির উত্তরাঞ্চলের মহামারী-কেন্দ্র বলে চিহ্নিত লোমবার্দির মতো বেশকিছু শহরে বিধিনিষেধ সামান্য শিথিল করা হয়েছে। ইতালির অর্থনীতির জনপ্রিয় দৈনিক সোলে-৪৪ এ একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় দেশের প্রায় ১৫০ জন শিক্ষাবিদের মতামত।
স্পেন
করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুর তালিকায় উইরোপে দ্বিতীয় অবস্থানে স্পেন। জারি করা হয় ‘স্টেট অব অ্যালার্ট’। কয়েকদিন বাদে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ সংকট মোকাবিলায় লকডাউন ঘোষণা করেন। সুপারমার্কেট এবং ফার্মেসি ছাড়া সবকিছু বন্ধ। গৃহবন্দী প্রায় চার কোটি মানুষ। সম্প্রতি মৃত্যুর হার কমে আসায় এক মাসের বেশি সময় পর লকডাউন শিথিল করেছে স্পেন। খুলে দেওয়া হয়েছে রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানাগুলো। উৎপাদন, নির্মাণসহ কয়েকটি সেবা খাতের সঙ্গে জড়িতদের কাজে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে দোকানপাট, বার, রেস্তোরাঁসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ রেখেছে স্পেন সরকার। কৃষি সংকট মোকাবিলায়, নতুন ফসল তোলা এবং নতুন ফসল বোনার জন্য কয়েক লাখ অবৈধ অভিবাসীকে কাজের নিশ্চয়তা দিচ্ছে স্পেন সরকার।
অস্ট্রিয়া
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জারি করা লকডাউন শিথিল করা হয়েছে অস্ট্রিয়ায়। তবে তা কেবল সম্ভব সরকারি দেওয়া কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে। দেশটির প্রতিটি নাগরিককে বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার এবং গণপরিবহনে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। দোকানপাট খুলেছে, তাতে বেঁধে দেওয়া হয় সময়সূচি। প্রাথমিকভাবে ৪০০ মিটারের কম আয়তনের দোকানগুলো খোলার অনুমতি দিয়েছে প্রশাসন। যদিও অস্ট্রিয়ায় মানুষজনকে এখনো কোনো প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অস্ট্রিয়ার বাসিন্দাদের আহ্বান জানিয়েছে দেশটির সরকার। ধীরে ধীরে দেশটিতে পুরো লকডাউন শিথিল করা হবে বলেও অস্ট্রিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
ভারত
ভারত করোনা লড়াইয়ে কিছুটা ধাক্কা খেলেও অনেকটা সামলে নিয়েছে দেশটি। দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করে ভারত সরকার বেশকিছু জায়গায় লকডাউন শিথিল করছে। আগামী ৩ মে পর্যন্ত লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও সম্প্রতি বেশ কয়েকটি রাজ্যে তা শিথিল করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে ‘গ্রিন’ ও ‘অরেঞ্জ’ জোন হিসেবে এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব রাজ্যের মধ্যে রয়েছে মহারাষ্ট্র, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশের কিছু এলাকা। তবে দিল্লি, পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটকে শিথিল করা হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, লকডাউন শিথিল হওয়া জেলাগুলোয় কৃষি ও শিল্পশ্রমিকরা এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র যাতায়াত করতে পারবেন। সে জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিবহনের ব্যবস্থা করবে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংক, এটিএম, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফার্মেসি এবং সরকারি অফিস খোলা থাকবে। এছাড়া স্ব-কর্মসংস্থান- যেমন প্লাস্টিক শ্রমিক, ইলেকট্রিশিয়ান, কাঠমিস্ত্রিরা তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাবে।
জার্মানি
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো লকডাউন প্রত্যাহারের পথে হাঁটছে জার্মানি। সম্প্রতি দেশটি লকডাউনের কিছু নিষেধাজ্ঞাও শিথিল করছে। ফলে পুনরায় কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দোকান চালু হতে যাচ্ছে। মাত্র চার সপ্তাহ পর লকডাউন তুলে দেওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে দেশটিতে। জার্মান সরকার সর্বোচ্চ ৮০০ মিটার আয়তনের দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কড়া নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে যত আয়তনেরই হোক না কেন বইয়ের দোকান, গাড়ি ও মোটরসাইকেল মেরামতের সব দোকান খোলার অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া জার্মানির বেশকিছু অঞ্চলে চিড়িয়াখানাও পুনরায় খুলে দেওয়া হয়েছে। আলোচনা-সমালোচনা যাই হোক, লকডাউন তুলে নেওয়ায় প্রাইমারি স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জার্মান সরকার। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধান বহাল থাকছে আগামী ৩ মে পর্যন্ত।
চেক রিপাবলিক
৯ এপ্রিল দেশটির সরকার সামাজিক দূরত্বে আরোপিত বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করেছে। খুব দ্রুত নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে দেশটির। গত সপ্তাহ থেকে নির্মাণসামগ্রী, আসবাবপত্রের দোকান, বাইকের শো-রুমগুলোর ওপর লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। অন্যদিকে কেবল মুদির দোকান, ফার্মেসি এবং বৃক্ষ নার্সারির কেন্দ্রগুলো চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে। তবে শিথিল করা দোকানপাটগুলোয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা হিসেবে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, বাধ্যতামূলক মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ইস্টার সানডের পর লকডাউন সম্পূর্ণ খুলবে কিনা তা বিবেচনা করবে।
ডেনমার্ক
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ডেনমার্কও লকডাউনের কঠোরতা শিথিল করতে যাচ্ছে। লকডাউন শিথিলের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রেস্তোরাঁ, স্কুল ও ডে কেয়ার সেন্টার, জিম এবং জেন্স বা ওমেন্স পার্লারগুলো খুলে দিয়েছে ডেনমার্ক।
গত তিন সপ্তাহ এসব বন্ধ ছিল দেশটিতে। এছাড়াও আগামীতে ধীরে ধীরে চালু করবে দেশটির সরকারি-বেসরকারি সব অফিস। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিক্সেন বলেন, আমরা এখনই পুরোপুরি বিপদমুক্ত না হলেও সঠিক পথেই আছি। সারা জীবন তো আমরা লকডাউনে থাকতে পারি না। তাই লকডাউনটি ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হবে। যা হবে অনেকটা ধীরে হাঁটার মতো।