কোয়ারেন্টিনেও গাদাগাদি, ঝুঁকিতে অর্ধশত ইন্টার্ন চিকিৎসক
পড়াশোনা শেষে সবে হাতেখড়ি; রোগীর সেবা করবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। হয়তো সে মন্ত্রেই ক’দিন আগেও দাপিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন তারা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় পিপিই’র পূর্ণ সেট মিলত না, কখনও-বা খুঁজে পাওয়া যেত না মুখের মাস্ক কিংবা হাতের গ্লোভসটাও। তাতে কী? জাতির দুর্দিনে তাই বলে তো আর সেবা থামিয়ে রাখলে চলে না! সেবা থামেওনি। কিন্তু নোভেল করোনাভাইরাস যে সেই স্বেচ্ছাসেবার শেকড়ে গিয়ে আঘাত হানবে, ক’দিন আগেও এই ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ক’জন জানত?
সপ্তাহখানেক ধরেই একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছেন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। দুইজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নেয়ার পর হাসপাতালটির স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। হাসপাতালটির ডাক্তার এবং নার্সসহ মোট প্রায় অর্ধশত স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। আক্রান্তদের সবাইকে আইসোলেশনে নেয়া হয়েছে। কলেজের ছাত্রাবাসে আলাদা রাখা হয়েছে রোগীর সংস্পর্শে থাকা অর্ধশতাধিক ইন্টার্ন ডাক্তারকে।
খোঁজে জানা গেছে, অর্ধশতাধিক ওই ইন্টার্ন ডাক্তাররা রোগীর সংস্পর্শে থাকলেও তাদের জন্য পৃথক কোনো থাকার ব্যবস্থা করা হয়নি। বরং কোয়ারেন্টিনেও গাদাগাদি করে কয়েকটি রুমে থাকতে হচ্ছে তাদের। যাদের মধ্যে একজনের করোনো উপসর্গ দেখা যাওয়ায় পরবর্তীতে তাকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়। ফলে উপসর্গ না থাকলে আতঙ্কে সময় কাটছে তাদের।
কোয়ারান্টাইনে থাকা ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. সজীব কুমার ঘোষ বলেন, ‘যথাযথ কোয়ারেন্টিন এবং আইসোলেশন নিশ্চিত করার জন্য আলাদা ঘর এবং সেই সাথে পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়া প্রয়োজন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এভাবে আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি সুরক্ষিত হলে কোয়ারেন্টাইন শেষে চিকিৎসা সেবা প্রদানে আমাদের কোন আপত্তি থাকবে না।’
ডা. সাইফ নামে একজন ইন্টার্ন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, আমরা সব ইন্টার্ন ডাক্তাররাই আতঙ্কে আছি। সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হচ্ছে; যার মধ্যে দুই-একজনের উপসর্গ দেখা গেছে। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে আমাদের সবার টেস্ট করানো হচ্ছে। আশার দিক হলো- ইতোমধ্যেই যাদের টেস্ট করানো হয়েছে, তাদের সবার রেজাল্ট নেগেটিভ। বাকিদেরও নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, বাকিটা রিপোর্ট হাতে পেলে বোঝা যাবে। তবে ঝুঁকিতে যে আছি, সেটা তো ভালো করেই বুঝতে পাচ্ছি।
খাদ্যসামগ্রী ঠিকমতো সরবরাহ হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ডা. সাইফ বলেন, এখনও পর্যন্ত ঠিকভাবে চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে চাহিদা পাঠানো হয়েছে, আশা করছি সমস্যা হবে না।
এর আগে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মোঃ রশিদ-উন-নবী বলেন, নমুনা পরীক্ষার সময় থেকেই ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’ করে আমরা চিহ্নিত করেছি। আক্রান্তদের কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি আছেন, বাকীদের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। এছাড়া তাদের ‘ক্লোজ কন্ট্যাক্টে’ ছিল এমন মানুষদের কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। এত বেশি সংখ্যক চিকিৎসক এবং সেবাকর্মী আক্রান্ত হয়ে পড়ায়, প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোন ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে মতামত চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি দেয়া হয়েছে।
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভ
এদিকে এতসংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট তো বটেই, অন্যান্য ডাক্তার এবং সেবাকর্মীদের মধ্যেও এক ধরণের ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি রয়েছে। নাম প্রকাশ না করা শর্তে কয়েকজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালে একটি করোনা ইউনিট থাকার পরেও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে তাদের যথেষ্ট পরিমাণে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ পিপিই সেটের মধ্যে গাউন, গ্লাভস, ফেস শিল্ড বা মুখ ঢাকার আবরণ, চোখ ঢাকার জন্য মুখের সাথে লেগে থাকে এমন চশমা, এবং মাস্ক থাকতে হবে। কিন্তু করোনা ইউনিটেই কিছু পিপিই গাউন ও গ্লাভস পাওয়া যায়। কিন্তু মাস্ক বিশেষ করে করোনাভাইরাসে সুরক্ষা দেয়ার উপযোগী এন-৯৫ মাস্ক দেয়া হয়নি তাদের।
বাস্তবায়ন হয়নি শিক্ষক সমিতির উদ্যোগ
এদিকে আক্রান্ত ইন্টার্নদের চিকিৎসা, আইসোলেশনে রাখা এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা অন্যদের কোয়ারান্টাইনে রাখা নিয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষক সমিতি এবং ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের (২০১৯-২০) তৎপরতায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি এখনও। যা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎকদের মধ্যে।
জানা যায়, গৃহীত ওইসব সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে, প্রথমত: ইন্টার্ন চিকিৎসকদের যারা পজিটিভ এসেছেন (ছেলে মেয়ে উভয়ই) তাদেরকে ইন্টার্ন হলের টপ ফ্লোরে আইসোলেশনে রাখা হবে (ছেলে মেয়ে আলাদা হলে)। যাদের নেগেটিভ আসবে তাদেরকে পর্যায়ক্রমে ইন্টার্ন হলের নীচের ফ্লোরগুলাতে কোয়ারান্টিনে রাখা হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক ইন্টার্ন চিকিৎসক এর জন্য ডক্টরস ক্যান্টিন থেকে খাবার পার্সেল করে হলে পৌঁছায়ে দেয়া হবে। এখানে বাজেটের অপ্রতুলতার কারণে খরচ আপাতত ইন্টার্ন চিকিৎসককেই বহন করতে হবে। সর্বোপরি, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের জন্য ২৪ ঘন্টা একটি অ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ডবাই রাখা হবে। কোন ইমারজেন্সি হলে যাতে তাদেরকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ট্রান্সফার করা যায়।
এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. উৎপল সেন জানান, “দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে মিটফোর্ড হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা রোগীর চিকিৎসায় অংশ নেয়ার জন্য হাসপাতালে যোগদান করেন। কিন্তু একমাস না যেতেই তাঁরা কয়েকজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এবং অন্যান্যরা বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে। যোগদানকৃত চিকিৎসকগণ প্রথম থেকেই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ইচিপের পক্ষ থেকে সবসময়ই চেষ্টা করা হয়েছে সমস্যা সমাধানের। ইতোপূর্বে ডক্টর ক্যান্টিনে খাবারের প্যাকেজ সিস্টেম করা হয়েছে, গ্লাভসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের এই সিদ্ধান্তসমূহ।”
সাধারণ সম্পাদক ডা. মেহেদী হাসান দীপ বলেন, “ইন্টার্নি চিকিৎসকগণ একটি হাসপাতালের প্রাণ। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই ইন্টার্ন চিকিৎসকদের যেকোনো সমস্যায় এবং যুক্তিযুক্ত প্রতিটি দাবির বাস্তবায়নে প্রাণের সংগঠন ইচিপ সবসময় অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখবে।”
অব্যবস্থাপনা মার্চ থেকেই
গত মার্চ মাসের ২১ তারিখ এক নোটিশে হাসপাতাল কর্মীদের নিজ দায়িত্বে মাস্ক জোগাড়ের জন্য আহ্বান জানায় কর্তৃপক্ষ। নোটিসে বলা হয়, ‘সম্পদের স্বল্পতার জন্য হাসপাতালের তরফ থেকে সবাইকে মাস্ক সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় ঝুঁকি এড়ানোর জন্য সকলকে নিজ উদ্যোগে মাস্ক ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করা হলো।’
পরে সমালোচনার মুখে ওই নোটিস প্রত্যাহার করা হয়। ওই ঘটনার কয়েকদিন পরেই সরিয়ে দেয়া হয় হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালককে।