বাংলাদেশের ‘পিকটাইম’ জুনের প্রথম সপ্তাহ
চীন থেকে উৎপন্ন হওয়া করোনাভাইরাস এখন সারাবিশ্বে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও দ্রুত বিস্তার লাভ করছে এ ভাইরাস। তবে দেশে যে হারে করোনা ছড়াচ্ছে তা উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আইইডিসিআর পরিচালকসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবকিছু সঠিকভাবে বলা যাবে না। তবে অনুমান করা যায়, দেশের পিকটাইম মে মাসের শেষ সপ্তাহ কিংবা জুনের প্রথম সপ্তাহ হতে পারে।
করোনায় ইতালি, স্পেন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। উদ্বেগজনক তথ্য হলো, ইতালির পর বাংলাদেশেই সবচেয়ে দ্রুততম দুই হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে।
ইতালিতে দুই হাজার কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়েছে ৩২তম দিনে। অথচ বাংলাদেশে হয়েছে ৪০তম দিনে। স্পেনে দুই হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৪১তম দিনে। ফ্রান্সে ও যুক্তরাজ্যে ৪৮ দিন সময় নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সেখানে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এ দেশের সাত লাখ মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। ৩৭ হাজার মানুষ ইতিমধ্যে মারা গেছেন।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কেয়ার ইংল্যান্ডের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, কেয়ার হোমে গত বছরের এ সময়ের তুলনায় সব ধরণের মৃত্যু মিলিয়ে সাড়ে সাত হাজার মানুষ বেশি মারা গেছে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৪৫৬ জনের করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। মারা গেছেন মোট ৯১ জন। এরমধ্যে গত ২৪ ঘন্টায় ৭ জন। দেশের ৫২টি জেলায় করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমন এখও দুঃসময়ে পৌঁছেনি, বরং সামনে আমাদের দুঃসময়। দেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে আরও সময় লাগবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিটি দেশেই দু-একজনের মাধ্যমে এ ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। পরে ধাপে ধাপে বিস্তার ঘটিয়ে মহামারি আকার ধারণ করে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার পর আবার ধাপে ধাপে সংক্রমণ হ্রাস হয়েছে। অনেক দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশে কমতে শুরু করেছে।
দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এরপর গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে দেখা গেছে। তবে এপ্রিলের শুরু থেকে প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে আরও ৩১২ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। একই সঙ্গে মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দুই হাজার ৪৫৬ জনে পৌঁছল। মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৯১ জনে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের পিকটাইম: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী মে মাসের শেষে অথবা জুনের শুরুতে দেশে এ ভাইরাসটি বিস্তারের পিকটাইম হতে পারে। অর্থাৎ ভাইরাসটি যে হারে দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে মে মাসের শেষ থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
বাংলাদেশে করোনার পিকটাইম সম্পর্কে জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এখনই কিছু বলা অত্যন্ত কঠিন। কারণ বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং এ ভাইরাসটি সম্পর্কে আমরা এত সীমিত জানি যে, সরাসরি উত্তর দেওয়া কঠিন। আমরা যে পূর্বাভাস দিয়েছি সেটি পরিবর্তন হতে পারে। প্রতিদিনই কিন্তু পূর্বাভাস পরিবর্তন হয়। ভাইরাসের অগ্রগতি ধীরগতি করার জন্য আমরা কাজ করছি। তবে এটি অগ্রসর হবে। এটি ধীরগতিতে যাতে বাড়ে, সে চেষ্টাই করছি। তাহলে এটির ব্যবস্থাপনা করতে কিছুটা সময় পাওয়া যাবে।’
ডা. ফ্লোরা বলেন, ‘সংক্রমণের হার দেখলে একটি বিষয় পরিস্কার হয় যে, অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে না। ধীরে ধীরে বাড়ছে। এতে আমাদের ধারণা হয়, আগামী মে মাসের শেষ অথবা জুন মাসে এটি পিক হতে পারে। তবে এটি শতভাগ নিশ্চিত নয়। এখনকার যে তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে আছে, তার আলোকে এটি বলছি। পরিস্থিতি পাল্টে গেলে এটার পরিবর্তন হতে পারে। এ ভাইরাসটির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো দেশের পূর্বাভাসই কিন্তু সঠিক হয়নি। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের পূর্বাভাস দিতে হয়।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, করোনার সংক্রমণ ও বিস্তারের বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সংক্রমণ শুরুর ৪৫ দিন পর ইতালিতে, ৫০ দিন পর স্পেনে এবং ৫৫ দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে এটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ৪৩ দিনের মাথায়ও সে রকম পরিস্থিতি হয়নি। কোন দেশে কীভাবে বিস্তার ঘটবে সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। আর আমাদের সমস্যাটি তো অন্য জায়গায়। দেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু লকডাউন করা হয়নি। এ লকডাউনের উদ্দেশ্য হলো- সময় গণনা করা। অর্থাৎ লকডাউন করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা। সারাদেশের মানুষ ঘরে আটকে থাকলে পরিস্থিতি কী ঘটে এবং তার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া। আমাদের তো লকডাউনই হয়নি। সারাদেশের মানুষ নিজের ইচ্ছে মতো ঘোরাঘুরি করছে। হাজার হাজার মানুষ দেখলাম জানাজায় অংশ নিল। তাহলে লকডাউনটা হলো কোথায়? এ অবস্থা চলতে থাকলে কবে ভাইরাসটির পিকটাইম হবে সেটি অনুধাবন করা কঠিন হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান জানানো হয়, তা পর্যালোচনা করলে আইইডিসিআর পরিচালক যা বলেছেন, সেটি ঠিক আছে। অর্থাৎ মে মাসের শেষ অথবা জুনে ভাইরাসটির ‘পিকটাইম’ হতে পারে। কিন্তু এখন যে ‘পিকটাইম’ চলছে না সেটি আমরা বুঝব কীভাবে? গতকাল সর্বোচ্চ আড়াই হাজারের কিছু বেশি মানুষের পরীক্ষা করে ৩১২ জন শনাক্ত করা গেছে। এত অল্প সংখ্যক মানুষের পরীক্ষা করে তো পিকটাইম চললেও তা কোনোদিনই বোঝা যাবে না। ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেনের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিদিন এসব দেশে হাজার হাজার মানুষ শনাক্ত হচ্ছেন। আমাদের দেশে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার পরীক্ষা করলেই বলা যাবে, সত্যিকার পিকটাইম কোনটি হতে পারে। আমাদের তো সেটি করা হচ্ছে না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, দেশের বর্তমান এ পরিস্থিতির জন্য আইইডিসিআর এককভাবে দায়ী। কারণ শুরুতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি তারা নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। পরীক্ষা কম হওয়ার কারণে সংক্রমণের সঠিক চিত্র অনুধাবন করা যায়নি। এখনও যে পরিমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে তাতে সংক্রমণের সঠিক চিত্র আসছে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিটি দেশেই দু-একজনের মাধ্যমে এ ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। পরে ধাপে ধাপে বিস্তার ঘটিয়ে মহামারি আকার ধারণ করে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার পর আবার ধাপে ধাপে সংক্রমণ হ্রাস হয়েছে। অনেক দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। আবার কোনো কোনো দেশে কমতে শুরু করেছে।
ঘরে বসেই করোনার চিকিৎসা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরে বসে যে কোনো আইনগত প্রয়োজনে আইনগত পরামর্শ বা তথ্য প্রাপ্তিতে সরকারি আইনগত সহায়তায় ২৪ ঘণ্টা সেবা পাওয়া যাচ্ছে জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টারের টোল ফ্রি (১৬৪৩০) নম্বরটিতে।
সংস্থার সহকারী পরিচালক (মনিটরিং) মাসুদা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা।
সংস্থার সহকারী পরিচালক (মনিটরিং) মাসুদা ইয়াসমিন স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আর্থিকভাবে অসচ্ছল সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আইনগত সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার আইন ও বিচার বিভাগের অধীনে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে সারাদেশে সংস্থার তত্ত্বাবধানে সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ এর বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরে বসে যে কোনো আইনগত প্রয়োজনে আইনি পরামর্শ বা তথ্য প্রাপ্তির উদ্দেশে সরকারি আইনগত সহায়তা জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টার টোল ফ্রি ১৬৪৩০ নম্বরটি ২৪ ঘণ্টা চালু রয়েছে।