উপসর্গ থাকলেও বলছেন না অনেকে, মন ভোলাচ্ছেন প্যারাসিটামলে
গোটা বিশ্বেই আতঙ্কের নাম করোনা। যদিও অনেকের কাছে তা এখনও সামাজিকভাবে অপদস্ত হওয়ার মত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেকেই করোনা সন্দেহে ভূগছেন। কিন্তু ইতস্তত হয়ে ডাক্তার কিংবা করোনা সেন্টারে যোগাযোগ করছেন না। আর এ বিষয়টাই যেমন পরিবার ও সমাজে করোনা রোগী বাড়াচ্ছে, তেমনি বিপদ বাড়াচ্ছে ডাক্তার-নার্সদের ক্ষেত্রেও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপসর্গ থেকেও তথ্য গোপনের এ বিষয়টিই ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
করোনার উপসর্গ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুগলেও অনেকে সহজেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চাইছেন না। এমনকি নিকটাত্মীয়-স্বজনের কাছেও তা গোপন রেখে প্যারাসিটামল বা অন্য কোনো অনুমাননির্ভর নানা ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। তবে এতে তারা সুস্থ না হয়ে বরং আরও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এ সময় তারা এসব উপসর্গ ও অনুমাননির্ভর ওষুধ খাওয়ার কথা গোপন রেখে অন্য রোগের কথা বলে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এতে ওইসব রোগীর মধ্যে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকলে তাদের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনদের পাশাপাশি চিকিৎসক-নার্স ও হাসপাতাল-ক্লিনিকের চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট অনেকেই সংক্রমিত হচ্ছেন। যা এখন সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার উপসর্গ গোপন করা মানুষের মধ্যে যারা আসলেই এ রোগে আক্রান্ত তাদের মাধ্যমেই এখন এর সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। অধিক সংখ্যক চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে এটিই সবচেয়ে বড় কারণ বলে দাবি করেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা।
তারা জানান, দেশে করোনা চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, এ কথা সত্য। তবে প্রাণঘাতী এ রোগের তথ্য গোপনের পেছনে সামাজিক হেনস্থা বিশেষভাবে দায়ী। অথচ এ রোগে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তি বিশেষের কোনো অপরাধ নয়। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষকে দ্রম্নত সচেতন করে তোলা না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, গত সপ্তাহে একজন রোগী পেটের পীড়ার কথা বলে তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন। তিনি তার পেটের কিছু প্যাথলজি টেস্টের সঙ্গে বুকের এক্সরে করতে দেন। পরে ওই রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট রোগীটি করোনায় আক্রান্ত বলে তার সন্দেহ হয়। তখন তিনি রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলেন। এক পর্যায়ে তারা রোগীর করোনার উপসর্গ থাকার কথা স্বীকার করেন। আইইডিসিআরে টেস্ট করার পর রোগীর শরীরে করোনার উপস্থিতি ধরা পড়ে। এ অবস্থায় তিনিসহ হাসপাতালের সবাই ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন- জানান ওই চিকিৎসক।
রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে অনেক রোগী তার চেম্বারে এসে ভিন্ন ঠিকানা দিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার চেষ্টা করেন। এমনকি অনেক রোগী প্রথমদিকে রোগের কিছু উপসর্গও গোপন করেন। এতে চেম্বারে নতুন রোগী দেখা এখন রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
উপসর্গগুলো কী কী?
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, কোন কোন লক্ষণ দেখে বুঝতে পারবো যে আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছি? করোনাভাইরাস মানুষের ফুসফুসে আক্রমণ করে। এর পর প্রধানত যে দুটো উপসর্গ দেখা দেয় তা হচ্ছে: জ্বর এবং বিরামহীন শুকনো কাশি। তো অনেকেই প্রশ্ন করেন শুকনো কাশি কী এবং অন্য কাশি থেকে এটি কীভাবে আলাদা?
শুকনো কাশিতে কোন শ্লেষা তৈরি হয় না। অর্থাৎ কাশি দিলে মুখ দিয়ে যে আঠাল তরল পদার্থ বেরিয়ে আসে শুকনো কাশির ক্ষেত্রে সেরকম হয় না। বিরামহীন কাশি বলতে বোঝায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রচুর কাশতে থাকা। এরকম অবস্থা হলে শরীর খুব খারাপ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এটা বোঝা যায় বুকের মধ্যে চাপ অনুভব করা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া অথবা দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অনুভূতির মাধ্যমে।
শরীরের তাপমাত্রা যদি ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয় তাহলে বুঝতে হবে আপনার জ্বর হয়েছে। জ্বর হলে আপনার শরীর গরম হয়ে যাবে, শীত শীত লাগবে অথবা শরীরে কাঁপনও ধরতে পারে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে আরো যেসব উপসর্গের কথা জানা যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে:
গলা ব্যথা
মাথা ব্যথা
ডায়রিয়া
গন্ধ না পাওয়া
মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাওয়া
এসব উপসর্গ দেখা দিতে সাধারণত গড়ে পাঁচ দিনের মতো সময় লাগে। আবার কারো কারো দেহে এসব লক্ষণ দেখা দিতে আরো বেশি সময়ও লাগতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণত ১৪ দিনের মধ্যেই উপসর্গ দেখা দেয়।
কতো মানুষের শরীরে উপসর্গ দেখা যায় না
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, কোভিড-নাইনটিন রোগীদের ৭৮ শতাংশের দেহে হালকা কিছু উপসর্গ দেখা দেয় অথবা তাদের শরীরে এর কোন উপসর্গই দেখা যায় না।
ইতালির একটি গ্রামে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ লোকের শরীরে কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু তারপরেও তাদের মাধ্যমে অন্যদের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে।সম্প্রতি আইসল্যান্ডেও একই ধরনের একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছে যাতে দেখা গেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ৫০ শতাংশের দেহে এর কোন উপসর্গ পাওয়া যায়নি।
আরেকটি গবেষণা, যেটি চালানো হয়েছে ৫৬ হাজারেরও বেশি রোগীর ওপর, তাতে বলা হয়েছে ৮০ শতাংশের শরীরে সামান্য কিছু উপসর্গ দেখা গেছে যার মধ্যে রয়েছে জ্বর এবং কাশি। কারো কারো নিউমোনিয়াও হতে পারে। বলা হচ্ছে, ১৪ শতাংশের বেলায় উপসর্গ গুরুতর রূপ নিতে পারে। যেমন শ্বাসকষ্ট। আর ৬ শতাংশ রোগী গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তাদের বেলায় ফুসফুস, কিডনিসহ কিছু জরুরি অঙ্গ অচল হয়ে যেতে পারে। এর ফলে মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়।