বাংলাদেশে ‘অ্যাভিগান’ তৈরি ও বাজারজাতকরণে সময় লাগবে
করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় কাজে আসতে পারে, এমন ওষুধ নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে বিশ্বের অনেক দেশের ছোট-বড় কোম্পানি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে এখনো সুনির্দিষ্ট কোন ওষুধ স্বীকৃতি দেয়া না হলে পরীক্ষামূলক ব্যবহারে কিছু ওষুধ নিয়ে আশাবাদ দেখা গেছে।
বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় যেসব ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের কিছু বেসরকারী ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান সেসব ওষুধ তৈরি করতে শুরু করেছে। তবে সবগুলো ওষুধ এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। স্বল্পন্নোত দেশ হওয়ার কারণে ওষুধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মেধাসত্ত্ব আইন প্রযোজ্য হয় না। মূলত হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও ফ্যাভিপিরাভির- এই দুইটি ওষুধ নিয়ে বিজ্ঞানীরা আশা দেখছেন।
ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসায় জাপানি কোম্পানি ফুজির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান তোয়ামা কেমিক্যাল তৈরি করেছিল। এই ওষুধটির ব্র্যান্ড নাম ‘অ্যাভিগান’। এখন এই ওষুধটির কার্যকারিতা নিয়ে নানা পরীক্ষা করা হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমা কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার করে কিছু সফলতা পাওয়া গেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ওষুধের কথা বারবার উল্লেখ করায় এটি নিয়ে আলোচনাও বেশি হয়েছে। যদিও করোনাভাইরাস চিকিৎসায় এর কার্যকারিতা নিয়ে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নন তার প্রশাসনের কর্মকর্তারাই। কয়েকটি দেশে ক্লোরোকুইন ব্যবহার করছেন চিকিৎসকরা। এটি মূলত ম্যালেরিয়ার ওষুধ হলেও করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে কিছুটা উপকার আনতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক গিলিয়াডের তৈরি রেমডিসিভির ওষুধ নিয়েও চলছে পরীক্ষামূলক ব্যবহার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো কোন ওষুধের ব্যাপারেই পুরোপুরি আস্থা ঘোষণা করেনি।
ফ্যাভিপিরাভির নিয়ে আশাবাদী চিকিৎসকরা
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের সভাপতি অধ্যাপক মো. বিল্লাল আলম বলেন, এখনো করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। কোন কোন দেশে হিউম্যান ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু সবমিলিয়ে সেগুলো চিকিৎসা ব্যবস্থায় আসতে আরও কয়েকমাস সময় লেগে যাবে।
বর্তমান চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও ক্লোরোকুইনের সঙ্গে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। এছাড়া ফ্যাভিপিরাভিরও ব্যবহারে বেশ সফলতা পাওয়া যাচ্ছে বলে তিনি বলছেন। ‘ফ্যাভিপিরাভির নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শতভাগ পরামর্শ দেয়নি, কিন্তু প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এটা নিয়ে আমরা বেশ আশাবাদী হয়ে উঠছি।’ জাপানের তোয়াহা কোম্পানির এই উপাদানের তৈরি ওষুধের ব্রান্ড নেম অ্যাভিগান।
অধ্যাপক আলম বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা আশি শতাংশ ক্ষেত্রে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। টেলিমেডিসিন দিয়েই বা ঘরে থেকেই তারা সুস্থ হয়ে যাবেন।
‘বাকি ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে, যেখানে নিউমোনিয়ার মতো সমস্যা থাকে, সেখানে আমাদের এসব ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। যাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা অন্যান্য সমস্যা থাকে, এসব ওষুধের পাশাপাশি তাদের সেসব সমস্যার ওষুধও দিতে হয়।’
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় যেসব ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে
বাংলাদেশের ন্যাশনাল গাইডলাইন অন ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট অফ করোনাভাইরাস ডিজিজ-এ বেশ করোনাভাইরাস চিকিৎসায় কয়েকটি ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস চিকিৎসা করতে গিয়ে এসব ওষুধ ব্যবহারে কিছুটা উপকার পাওয়া গেছে বিধায় এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এর কোনটাই করোনাভাইরাস পুরোপুরি দূর করতে সক্ষম হয় না।
বাংলাদেশে ওষুধ নিয়ে প্রস্তুতি কতটা?
করোনাভাইরাস মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোও এসব ওষুধ প্রস্তুত করে রাখতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের পাশাপাশি ফ্যাভিপিরাভি, ওসেল্টামিভি ও ইভারমেকটিন প্রস্তুত করবে বলে জানিয়েছে বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এসকেএফ।
জাপানে ফুজির তৈরি ফ্যাভিপিরাভির ওষুধটির ব্রান্ড নেম অ্যাভিগান। এটি করোনাভাইরাস রোগীদের সুস্থ করতে পারে কিনা, তা নিয়ে এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
বাংলাদেশের আরেকটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বিকন ফার্মা ফ্যাভিপিরাভির তৈরি করতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে।বাংলাদেশের এক দৈনিককে বেক্সিমকো ফার্মার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, রেমডেসিভির বাদে অন্য সবগুলো ওষুধ প্রস্তুত করতে শুরু করেছেন। অনুমোদন পাওয়া গেলেই তারা সরবরাহ শুরু করবেন। এছাড়া জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালস, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসও এ ধরণের ওষুধ তৈরি করতে শুরু করেছে।
অধ্যাপক বিল্লাল আলম বলেন, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, ক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। কোম্পানিগুলো নিয়মিত উৎপাদন করছে। এছাড়া ফ্যাভিপিরাভির উৎপাদন শুরু করেছে বেক্সিমকো, ইনসেপটা, বিকন ফার্মাসহ কয়েকটি কোম্পানি। তারা এর মধ্যেই বাজারজাত করার জন্য আবেদন করেছে।
টিকা আবিষ্কারের কতদূর?
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল টাইম পত্রিকাকে জানিয়েছেন যে, আগামী চার মাসের মধ্যেই টিকা প্রস্তুত হতে পারে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে মানবদেহে এর পরীক্ষামূলকভাবে কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে। মানবদেহে করোনার টিকা পরীক্ষার তিনটি ধাপে সফল হলেই তা আক্রান্তের দেহে প্রয়োগ করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ৩৫টি একাডেমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস ও যুক্তরাষ্ট্রের মর্ডানা থেরাপেউটিকস এর মধ্যেই করোনা টিকার ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা চালিয়েছে।
গতমাসেই যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে প্রথমবারের মতো মানব শরীরে পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রাণীর ওপর কোন পরীক্ষা না চালিয়েই মানব শরীরে পরীক্ষা চালানো হয়। এপ্রিলের শেষ নাগাদ মানব শরীরের পরীক্ষা চালানোর আশা করছে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা। সবগুলো পরীক্ষা সফল হবে এমন নয়। তবে সফল হলেও সবমিলিয়ে বড় আকারে বাজারে আসতে ২০২১ সালের মাঝামাঝি নাগাদ সময় লেগে যাবে।
এটাও মনে রাখতে হবে, বর্তমানে মানব শরীরে চার ধরণের করোনাভাইরাস দেখা যায়। কিন্তু এগুলোর কোনটির টিকা আবিষ্কৃত হয়নি।-বিবিসি বাংলা