সুস্থ হয়ে উঠা রোগীর রক্তে বেঁচে যাচ্ছে আক্রান্তরা, রক্তদানের হিড়িক
করোনাভাইরাস আক্রান্ত যেসব মানুষ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ব্লাড ডোনেশন সেন্টারগুলিতে এখন তাদের রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা মনে করছেন, এদের রক্তে আছে এমন এক উপাদান, যা করোনাভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
বিজ্ঞানীরা এই রক্ত ব্যবহার করে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় যে কৌশল অবলম্বনের কথা চিন্তা করছেন তাকে বলে ‘কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি।’ চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি বেশ পুরোনো একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সাধারণত কোন ভাইরাল সংক্রমণ থেকে সেরে উঠা মানুষের রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই রক্ত সঞ্চালিত করা হয় একই ধরনের ভাইরাল সংক্রমণের শিকার রোগীর দেহে।
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারি এবং ১৯৩০ এর দশকে হামের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছিল। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে ইবোলা, সার্স এবং ‘এইচ-ওয়ান-এন-ওয়ান’ এর মতো রোগের চিকিৎসায়ও এটি ব্যবহার করা হয়েছে।
কতটা কার্যকর এই চিকিৎসা
‘কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি’ নিয়ে প্রাথমিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা আশার আলো দেখছেন, তবে এখনো তারা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছেন না এটি পুরোপুরি কাজ করবে কীনা। চীনে করোনাভাইরাসের মহামারি শুরু হওয়ার পর সেখানে প্রথম এটি নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়।
শেনঝেন পিপলস হাসপাতাল এনিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে ২৭শে মার্চ। চীনের ‘ন্যাশনাল ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ’ এই হাসপাতালেই। ৩৬ হতে ৭৩ বছর বয়সী পাঁচজন রোগীর ওপর এই পদ্ধতিতে চালানো চিকিৎসার ফল বর্ণনা করা হয়েছে এতে। কোভিড-নাইনটিন থেকে পুরোপুরি সেরে উঠা পাঁচজনের রক্ত সঞ্চালিত করা হয় এই পাঁচ রোগীর দেহে। ১২ দিনের চিকিৎসার পর এদের সবাই পুরোপুরি সেরে উঠেছেন বলে চীনা গবেষকরা দাবি করছেন।
এই পদ্ধতির সাফল্য ব্যাপক ক্লিনিকাল ট্রায়ালে এখনো সম্পূর্ণ প্রমাণিত নয়। তারপরও এটির মধ্যে কিছু সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
যুক্তরাষ্ট্রে কনভালেসেন্ট প্লাজমা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের একজন ডঃ লুইস কাটয। তিনি বলছেন, কোভিড-নাইনটিনের চিকিৎসায় সেরকম কিছু যেহেতু এখনো পর্যন্ত নেই, তাই তারা কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপিকে একটি সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে দেখছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেস টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “এটি যে বেশ উপকারি হতে পারে সেরকম ঐতিহাসিক নজির আমাদের কাছে আছে। আর এরকম তথ্য-উপাত্তও আমাদের কাছে আছে যা দেখে আমরা মনে করছি এই পদ্ধতি নিরাপদ।”
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন গত সপ্তাহেই কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। কেবল গুরুতর অসুস্থ কোভিড-নাইনটিন রোগীদের জরুরী চিকিৎসায় ডাক্তাররা এই থেরাপি ব্যবহার করতে পারবেন বলে জানাচ্ছে লস এঞ্জেলস টাইমস। হিউস্টন মেথডিস্ট হাসপাতাল যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এই থেরাপি ব্যবহার করেছে।
রক্ত সংগ্রহের হিড়িক
কোভিড-নাইনটিন থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠা রোগীদের রক্ত সংগ্রহের জোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। নিউ ইয়র্ক ব্লাড সেন্টার গত সপ্তাহ থেকে এরকম রোগীদের রক্ত সংগ্রহ শুরু করেছে। আমেরিকান রেডক্রস সম্ভাব্য রক্তদাতাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি ওয়েবসাইট খুলেছে।
রক্তদাতারা যখন রক্ত দিতে আসবেন তাদের কয়েকটি পরীক্ষা করা হবে। প্রথমত তাদের কোভিড-নাইনটিন হয়েছিল কিনা। দ্বিতীয় পরীক্ষায় দেখা হবে তারা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন কিনা, অর্থাৎ এখন তাদের কোভিড-নাইনটিন পরীক্ষার ফল নেগেটিভ কিনা। আর তাদের প্রথম কোভিড-নাইনটিনের লক্ষণ দেখা দেয়ার পর ২৮ দিন পার হয়েছে কিনা।
কোভিড-নাইনটিন থেকে সেরে উঠা এরকম এক রোগী নিউ ইয়র্কের ডায়ানা বেরেন্ট এখন তার রক্ত দেয়ার জন্য উদগ্রীব। মার্চের মাঝামাঝি তার লক্ষণ ধরা পড়েছিল। লং আইল্যান্ড এলাকায় যাদের প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে, তিনি তাদের একজন। এ সপ্তাহে তার রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। যদি তার রক্তে যথেষ্ট ‘এন্টিবডি’ পাওয়া যায়, অন্য রোগীদের জন্য তার রক্ত সংগ্রহ করা হবে।
ডায়ানা বেরেন্ট বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, “এক অভূতপূর্ব, ভীতিকর সময় পার করছি আমরা। সবকিছুই এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। করোনাভাইরাস থেকে আমরা যারা সেরে উঠেছি, আমরা যদি এভাবে রক্ত দিয়ে অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে পারি, আমরা হতে পারি সুপারহিরো।”- বিবিসি বাংলা