বাংলাদেশে লক্ষণ পাওয়া মাত্র ৩ ভাগ করোনায় আক্রান্ত
বাংলাদেশে পরপর দুইদিন করোনা রোগী শনাক্ত না হওয়ার পর সোমবার একজনের দেহে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। এ নিয়ে ১৩ শ ৩৮ জনকে টেস্ট করে ৪৯ জনের (আজকের হিসাব ছাড়া) দেহে করোনা শনাক্ত হলো। অর্থ্যাৎ লক্ষণ থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ ভাগ। যদিও করোনার উপসর্গ আছে এরকম অনেকেই অভিযোগ করছেন, টেস্ট করাতে চেয়েও আইইডিসিআরের সাড়া পাচ্ছেন না তারা।- খবর বিবিসি বাংলার
আবার ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ছাড়া বাকী বিভাগীয় শহরগুলোতে এখনো ল্যাব প্রস্তুত না হওয়ায় প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ কিভাবে টেস্টের আওতায় আসবেন তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে ঢাকার বাইরে ল্যাবরেটরিগুলো চালু হতে এতো সময় কেনো লাগছে? আর করোনা শনাক্তের টেস্ট করতেই বা এতো যাচাই-বাছাই কেন?
একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন আমিনুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। হঠাৎ করেই শরীরে সর্দি-জ্বরের সঙ্গে শুরু হয় গলা ব্যাথা। ডায়রিয়াও শুরু হয়। ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করায় সম্প্রতি বিভিন্ন ধরণের মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন আমিনুল। ফলে করোনার উপসর্গ শরীরে দেখা দেয়ায় ভয় পেয়ে যান তিনি। ওই দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সংযোগ পাননি।
তিনি বলছিলেন, ‘আমি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করি। কত ধরণের লোক আসে অফিসে। সে জন্যেই ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু টেস্ট করাতে গিয়ে দেখি হটলাইনে কাউকেই পাওয়া যায় না। পরের দিন সরাসরি আইইডিসিআরে'র কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। তারা বলেছে হটলাইনেই চেষ্টা করতে। কিন্তু সেটা আর হয় নাই।’ আমিনুল পরের দিন গ্রামে চলে যান।
এখন শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ তিনি। কিন্তু করোনা ভাইরাস শরীরে থাকতে পারে এমন আশংকায় নিজেকে আলাদা করে রেখেছেন তিনি। এই ব্যক্তির মতো আরো অনেকেই আছেন, যারা করোনা শনাক্তের টেস্ট করাতে চেষ্টা করেও হটলাইনে সংযোগ পাননি। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সরাসরি আইইডিসিআরের কার্যালয়ে গেলেও লাভ হয়নি। আবার যারা যোগাযোগ করতে পেরেছেন এবং টেস্ট করানোর জন্য আইইডিসিআরের তালিকাভূক্ত হয়েছেন তাদেরও কেউ কেউ ভোগান্তিতে পড়েছেন।
প্রথমত: টেস্ট করানোর জন্য তদ্বির করতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত: তালিকাভূক্ত হয়েও অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে একাধিক দিন।
এরকম একজন নারীর সঙ্গে কথা হয়। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই নারী বলছিলেন তার অভিজ্ঞতা। ‘আমার লক্ষণ শুনে আইইডিসিআর থেকে বলা হয়, আমার করোনা টেস্ট করা হবে। দ্রুত লোক পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সেদিন টেস্টের জন্য কোন লোক আসেনি। পরদিনও আসেনি। ফোন করলে বলে দ্রুত পাঠাচ্ছে।’ তিনি বলছেন, ‘এভাবে তিন দিন চলে যায়। এদিকে আমার শ্বাসকষ্ট বাড়ছিলো। অবস্থা দেখে আমার পরিচত কয়েকজন তদবিরের চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ দিনের মাথায় এসে স্যাম্পল নিয়ে যায় আইইডিসিআরে'র লোক।
পরীক্ষায় এতো যাচাই-বাছাই কেন?
গত ২৫ মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্টে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ৬৫ হাজার। অথচ ৫ দিনের ব্যবধানে ৩০ মার্চে এসে সেই সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যায়। দেশটিতে হঠাৎ করেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে, দেশটির প্রায় সবগুলো অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক ভিত্তিতে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো। অথচ বাংলাদেশে শুরু থেকেই এর উল্টো চিত্র।
প্রথমে শুধু বিদেশ ফেরত কিংবা তাদের সংস্পর্শে এসেছেন এরকম ব্যক্তিদের মধ্যে করোনার উপসর্গ থাকলে টেস্ট করা হয়েছে। এখন এর আওতা বাড়িয়ে ষাটোর্দ্ধ বয়সী এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ যাদের রয়েছে কিংবা যারা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এবং এর কারণ নির্নয় করা যায়নি তাদেরকেও টেস্টের আওতায় অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে।
এছাড়া চিকিৎসা, গণপরিবহন খাতের মতো পেশার সঙ্গে জড়িতদেরও করোনার উপসর্গ থাকলে টেস্টের আওতায় আনা হচ্ছে। যারা এর বাইরে তাদের কোয়ারেন্টিনে থেকে উপসর্গ ভিত্তিক চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে। কিন্তু টেস্ট করানো হচ্ছে না। এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এরকম অনেকেই জানাচ্ছেন, উপসর্গ থাকার পরও তাদের টেস্ট করানো হচ্ছে না। আবার অনেকেই টেস্টের জন্য হটলাইনেও যোগাযোগ করতে পারছেন না।
প্রতিদিন হটলাইনে হাজার হাজার কল আসলেও পরীক্ষা হচ্ছে অল্প সংখ্যায়। সোমবার পর্যন্ত এই সংখ্যা ১,৩৩৮। ফলে প্রশ্ন উঠছে, ব্যাপক ভিত্তিতে টেস্ট করতে আইইডিসিআরের সক্ষমতার অভাব আছে? নাকি এতো টেস্টের প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে না? আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা অবশ্য বলছেন, উপসর্গ থাকলেই টেস্ট করাতে হবে বিষয়টি এমন নয়।
‘এখানে সক্ষমতার প্রশ্ন নেই। যাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা প্রয়োজন তাদের প্রত্যেকেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। ...আমাদের দেশে সংক্রমণ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েনি যে, কারো জ্বর-কাশি হলেই সেটাকে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ভাবতে হবে। আমরা রোগীর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেই।’
তিনি বলছেন, ‘যার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক টেস্ট প্রয়োজন, সেখানে সেভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হয়। আর কারো ক্ষেত্রে যদি এরকম হয় যে, কেবলমাত্র জ্বর রয়েছে অথবা কাশি। সেক্ষেত্রে আমরা তাকে পরামর্শ দেই আরেকটু পর্যবেক্ষণ করার জন্য এবং আমরাও তাকে পর্যবেক্ষণে রাখি।’
ঢাকার বাইরে ল্যাব স্থাপন কতদূর?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কয়েকবারই জানানো হয়েছে যে, শীগগিরই ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতে ল্যাব চালু হবে। কিন্তু চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য কোন বিভাগে সেটা চালু হয়নি।
রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, সিলেট এবং ময়মনসিংহে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় এর কোনটিতেই এখনো পর্যন্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি। কোথাও বায়ো সেফটি'র কাজ চলছে, কোথাও পিসিআর মেশিন ইনস্টলের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে ময়মনসিংহ এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে জানানো হয়, দুয়েকদিনের মধ্যেই তাদের ল্যাবে পরীক্ষা শুরু করা যাবে বলে আশাবাদি তারা। কিন্তু এসব ল্যাব চালু হতে এতো সময় লাগছে কেনো?
এমন প্রশ্নে আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, মূলত: যারা ল্যাবে পরীক্ষার কাজ করবেন তাদের নিরাপত্তা এবং সেখান থেকে যেন সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে সেটা নিশ্চিত করার জন্যই প্রস্তুতিতে সময় নেয়া হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, কয়েকদিনের মধ্যেই কোন কোন ল্যাবে পরীক্ষা শুরু করা যাবে। -বিবিসি বাংলা