মৃত করোনা রোগীর চিকিৎসকের কোয়ারেন্টাইন থেকে আবেগঘন লেখা
পিপিই ছাড়া করোনাভাইরাসে (কোভিড ১৯) রোগীর সেবা দিয়ে সহপাঠী এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী ১৮ মার্চ থেকে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। কিভাবে কাটছে তার কোয়ারিন্টিনের দিনগুলো? নিজেই জানিয়েছেন তিনি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য তার লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হল-
‘বন্দি জীবনের কতকথা! হোম কোয়ারেন্টিনে আমি। রুম বন্ধ। আমি চারদিকে তাকিয়ে নানা কিছু শুধু ভাবি। খুব সকালে ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে দেখি, ভোর পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। খুব অস্থির লাগছিল। শান্ত হতে অজু করে ফজরের নামাজ পড়তে দাঁড়ালাম।
গত ১৬ মার্চ আমার প্রাইভেট চেম্বার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে এক বয়স্ক রোগীকে দেখি এবং আন্দাজ করি এটি কভিড-১৯ জনিত নিউমোনিয়া। এরপর ওষুধপত্র দিয়ে পরামর্শ দেই, দ্রুত আইইডিসিআরে যোগাযোগ করার জন্য।
১৮ মার্চ সকালে গায়ে সামান্য জ্বর অনুভব করি। তড়িঘড়ি করে বাসায় প্রবেশ করি। সহকর্মীরাও বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। বাসায় ফিরে স্ত্রীর ছল্ ছল্ চোখ আর উদ্বেগ ভরা প্রশ্নের উত্তরে অভয় দেই, এই আইসোলেশন রোগ নয়, রোগী না হবার জন্য আগাম সতর্কতা।
বইপাগল আমি আজ সময় কাটাচ্ছি বহুদিনের জমে থাকা, না পড়া বইয়ে ডুবে আর নেটে বিভিন্ন দেশের করোনা মহামারীর খবর পড়ে। ১৯ মার্চ জানতে পারি, আমার ওই রোগীটি কভিড-১৯ পজেটিভ এবং তিনি ভেন্টিলেটরে!
আমার সন্দেহপ্রবণ মনটিকে ধন্যবাদ দেই, আগাম সতর্ক করার জন্য। দুঃখজনক সত্য হলো, টোলারবাগের সেই রোগীটি পরবর্তীতে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান বলে জানতে পারি। মানুষ অসুস্থ হলে চায় প্রিয়জনের স্নেহ, স্পর্শ। আর আজ কি না দূরে যাও তুমি, আরো দূরে; যদি হতে চাও মনের কাছাকাছি...! অদৃশ্য এই শত্রু মানবে না কোনো বাধা বারবার হাত ধোয়া আর আইসোলেশনের শৃঙ্খলা ছাড়া।
হায় পজেটিভ!
ভাবছি, সারাজীবন পজেটিভ থিংকিং আর পজেটিভ রাজনীতির কথা বলি আমরা। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রে পজেটিভ মানে খারাপ কিছুর অস্তিত্ব প্রকাশ পাওয়া। বাক্য প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে একই শব্দের ভিন্নমুখী দোতনা। এ যেন সার্জনের হাতের ছুরি ঘাতকের অস্ত্র হয়ে যাওয়া!
‘হে প্রভু, হে মহান রাব্বুল আলামীন, তুমি রক্ষা করো আমাদের। চোখের পানিতে অন্তরের এ আকুতি শুধু আমার নয়; সারা দেশের সারা পৃথিবীর মানুষের। ইতালিতে সত্তরোর্ধ কভিড-১৯ আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ৩৫ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে।
হায় ইতালি! আধুনিক ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমার দেশের কি অবস্থা হবে?
এখন গাইডলাইন মেনে দুই বেলা শরীরের তাপমাত্রা মাপি। স্বেচ্ছা বন্দিত্বের নবম দিনে অপেক্ষা করি আরো পাঁচ দিন পরের স্বাধীনতার জন্য। অপেক্ষা করি স্ত্রী আর একমাত্র সন্তানকে আলিঙ্গনের উষ্ণতার জন্য।
সুস্থ থাকলে হয়তোবা আবারও হব কর্মচঞ্চল। কিন্তু আমাদের অপ্রতুল স্বাস্থ্য ক্ষমতা কতটুকু রক্ষা হবে করোনা মহামারী প্রতিরোধের জন্য? হে প্রভু, হে মহান প্রভু, রক্ষা করো এই দেশ। রক্ষা করো সোনার বাংলাকে।’