‘সুুপার ফুড’ স্পিরুলিনায় সুপার প্রতিষেধক
স্পিরুলিনা নামটি শুনেই অনেকের ভ্রু কুচকে গেল তাইনা? এটা আবার কি জিনিস? এই “সুুপার ফুড” স্পিরুলিনায় রয়েছে বিভিন্ন রোগের সুপার প্রতিষেধক। তবে আসুন তাহলে জেনে নেই স্পিরুলিনা সর্ম্পকে। স্পিরুলিনা একটি নীলাভ-সবুজ শৈবাল। এটি সাধারনত পানিতে জন্মে। তবে সামুদ্রিক শৈবাল হিসেবেই এটি বেশী পরিচিত।
স্পিরুলিনা নামটি নেয়া হয়েছে মূলত ল্যাটিন শব্দ Spira হতে যার অর্থ সর্পিলাকার বা পাকানো। কারণ স্পিরুলিনা দেখতে সর্পিলাকারের হয়ে থাকে। এটি সাধারণত সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে থাকে। স্পিরুলিনা সাধারণত সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। স্পিরুলিনা নামটি অপরিচিত হলেও এটিতে প্রায় সবধরনের নিউট্রিয়েন্ট রয়েছে তন্মধ্যে প্রোটিন (৬০-৭০ শতাংশ) যার বেশীরভাগই ইসেনশিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড দিয়ে গঠিত, কার্বোহাইড্রেট (১৫ শতাংশ) হিসেবে থাকে গ্লাইকোজেন, ফ্যাট (৫-৮ শতাংশ) মূলত ইসেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিড যেমন গামা লিনোলেয়িক এসিড বেশী পরিমানে থাকে, এছাড়াও মিনারেলস এর মধ্যে রয়েছে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও সেলেনিয়াম, ভিটামিনের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৬, বি১২, ভিটমিন-ই ও ভিটমিন-কে। আর ন্যাচারাল পিগমেন্ট এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক্লোরোফিল, জ্যান্থোফিল, বিটা ক্যারোটিন ও ফাইটোসায়ানিন। এটিতে সবধরনের পুষ্টিউপাদান বিধ্যমান থাকায় এটিকে “সুপার ফুড” বলা হয়।
এটিকে সুপার ফুড বলার আরও কয়েকটি কারন নিন্মে দেওয়া হলো- এতে মাছ ও গরুর মাংসের তুলনায় ৩ গুণ এবং ডিমের তুলনায় ৬ গুন বেশী প্রোটিন রয়েছে। সয়াবিনের তুলনায় ২ গুণ বেশী মিনারেল রয়েছে। আটার থেকে ৪ গুণ বেশী ফাইবার বা খাদ্য আঁশ রয়েছে স্পিরুলিনাতে। এতে গাজরের তুলনায় ৫ গুণ ও পালংশাকের তুলনায় ৪০ গুণ বেশী ক্যারোটিন রয়েছে। দুধের তুলনায় ১০গুণ বেশী ক্যালসিয়াম রয়েছে এই শৈবালে। এছাড়াও এতে পালংশাকের তুলনায় ৬৫ গুণ বেশী এবং গরুর মাংসের তুলনায় ৩০ গুণ বেশী আয়রন থাকে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন এটি কতটা পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি সবজি। আসুন এবার জেনে নেয়া যাক স্পিরুলিনার ঔষধি গুণাগুণ সম্পর্কে।
গর্ভবতী মায়ের রক্তাল্পতা প্রতিরোধে
স্পিরুলিনাতে প্রচুর পরিমাণে ক্লোরোফিল রয়েছে যা রক্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিমোগ্লোবিন-এ রূপান্তরিত হতে পারে এবং রক্তাল্পতা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। তাছাড়াও স্পিরুলিনাতে ভিটামিন বি১২, ফলিক এসিড, আয়রন ও অ্যামাইনো এসিড রয়েছে যা রক্ত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভেজিটেরিয়ানদের আদর্শ খাবার
স্পিরুলিনাতে অধিক পরিমানে প্রোটিন ও ভিটামিন বি১২ রয়েছে যা ভেজিটেরিয়ানদের এই দুটি পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি কমায়। কারন ভেজিটেরিয়ানদের খাদ্য তালিকায় প্রোটিন ও ভিটামিন বি১২ অনুপস্থিত থাকে।
রক্ত পরিষ্কার করতে
এতে প্রচুর পরিমানে ক্লোরোফিল ও ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। এই ক্লোরোফিল ও ম্যাগনেসিয়াম মিলিত হয়ে রক্তের দূষক পদার্থসমূহ দূর করে এবং রক্ত পরিষ্কার করতে সহায়তা করে।
আর্সেনিকোসিস প্রতিরোধে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ডাক্তার ও ইঈঝওজ এর বিজ্ঞানীরা ৬০ জন রোগীর উপর গবেষনা চালিয়ে দেখেন, প্রতিদিন ৯-১০ গ্রাম করে স্পিরুলিনা খাওয়ালে ৪-৬ মাস পর রোগীর আর্সেনিকজনিত চর্মরোগ (আর্সেনিকোসিস) সম্পুর্ণরূপে উপশম হয়।
হৃদরোগের ঝুকি কমায়
এতে উচ্চমাত্রায় গামা লিনোলেয়িক এসিড রয়েছে যা দেহের ক্ষতিকারক এলডিএল এর মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগের ঝুকি কমায়।
ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে
স্পিরুলিনা ক্যান্সার হওয়া থেকে শরীরকে রক্ষা করে। স্পিরুলিনার নীল-সবুজ রঙ এটা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। স্পিরুলিনা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন সেলেনিয়াম, বিটা ক্যারোটিন, টোকোফেরল, ফেনলিক এসিড সমৃদ্ধ যা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।
হজমশক্তি বৃদ্ধি করে
ই-কোলাই এবং ক্যান্ডিডার মত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি দমন করে । স্পিরুলিনা পাচনতন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া ষধপঃড়নধপরষষঁং ও নরভরফড়নধপঃবৎরধ মত ভাল ব্যাকটেরিয়া তৈরী করে। সুতরাং, এটা পুষ্টি শোষণ করে শরীরের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে হজম বাড়ায়।
কিডনিকে বিষাক্ততা থেকে রক্ষা করে
স্পিরুলিনা ক্লোরোফিল একটি উচ্চ ঘনত্ব সম্পন্ন এবং সেরা প্রাকৃতিক ফবঃড়ীরভরবৎং; এটা কিডনি থেকে ভারী ধাতু, ক্ষতিকারক রশ্মি, এবং দূষণকারী ধাতু সরিয়ে কিডনির বিষাক্ততা কমায়
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে
এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে। কারন এতে প্রচুর পরিমানে ফাইবার রয়েছে যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সহজে বাড়তে দেয়না।
বর্তমানে আমাদের দেশে এটি খাওয়ার প্রচলন খুবই কম, সুতরাং আমরা যদি অদূর ভবিষ্যতে স্পিরুলিনার উৎপাদন বাড়াতে পারি তাহলে যেমন সুস্বাস্থ্যবান নাগরিক আমরা পাব, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হব। আসুন স্পিরুলিনা চাষ করি, স্বাস্থ্যবান জাতি ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সহায়তা করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: billalanftiu@gmail.com