কীভাবে এলো মাহে রমজানের রোজা?
রমজান শব্দটি আরবি শব্দ৷ যার অর্থ জ্বালানো,পোড়ানো বা ভস্মীভূত করা। যেহেতু এ মাসে বান্দাহর গুনাহ জ্বলে-পুড়ে (মুছে) যায় অথবা গরমকালে এ মাসের নামকরণ করা হয় তাই এ মাসকে ‘রমজান’ বলা হয়৷ ইসলামী বর্ষ পঞ্জিকা অনুসারে রমযান হচ্ছে ৯ম মাস৷ আরবি ক্যালেন্ডারের মাসসমূহের মধ্যে রমযানই একমাত্র মাস; যার কথা আল কুরআনে এসেছে।
আর রোজা শব্দটি ফার্সি শব্দ৷ রোজার আরবি শব্দ সওম৷ (তবে রোযা শব্দটি সওম এর জন্যে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই ব্যবহৃত হয়) যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। পরিভাষায় সওম বলা হয়-প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ মুসলমান নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোজা ভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। হাদিস অনুসারে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে সওমের অবস্থান চতুর্থ৷
রাসূল (স.) সাহাবীগণসহ মদিনায় হিজরত করার প্রায় ১৮ মাস পর শাবান মাসের ১০ তারিখে পুরো রমযান মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ পাক নাযিল করেন-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِيَ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ
هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
অর্থ: রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা'আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। [ সুরা বাকারা ২:১৮৫]
তবে এর পূর্বেও আগের জাতিগুলোর জন্য রোযা আবশ্যক ছিল যদিও তা রমযানের জন্য নির্দিষ্ট ছিল না৷ পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের রোযার সময় ও সংখ্যার ক্ষেত্রে পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। আগেকার যুগে রাতে নিদ্রা যাওয়া থেকেই রোজা শুরু হয়ে যেত। ইফতারের পর থেকে শয্যা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্তই শুধুমাত্র পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসবকিছু হারাম হয়ে যেত।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَام كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থ: ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার। [ সুরা বাকারা ২:১৮৩ ]
আলোচ্য আয়াতের من قبلكم এর ব্যাখ্যায় আল্লামা আলুসী (রহ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ রুহুল মাআনীতে উল্লেখ করেছেন- এর দ্বারা আদম (আ.) থেকে ঈসা (আ.) এর জাতিকে বোঝানো হয়েছে৷
হযরত আদম (আ) যখন নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করেন তখন নাকি ৩০ দিন পর তার তাওবা কবুল হয়৷এরপর তার সন্তানদের উপর ৩০ রোযা আবশ্যক করে দেওয়া হয়৷ (ফাতহুল বারী:৪র্থ খন্ড, পৃ- ১০২-১০৩)
নূহ (আ) এর যুগেও রোজা ছিল৷ ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছিঃ নূহ (আঃ)- ঈদুল ফিতরের দিন ও ঈদুল আযহার দিন ব্যতীত সারা বছর রোযা রাখতেন। (ইবনে মাজাহ-১৭১৪)
ইব্রাহিম (আ.) এর রোজা সম্পর্কে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, ইব্রাহিম (আ.) প্রতি মাসের তিনদিন রোজা রাখতেন (ইবনে মাযাহ)। ইমাম তারারী (রহঃ) বলেন, রমজানের ত্রিশ রোজা ফরজ ছিল হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর উপর প্রদত্ত ফরজ এর অনুযায়ী (তাবারী)।
মূসা (আ) তুর পর্বতে অবস্থান কালে সর্বমোট ৪০টি রোযা রেখেছিলেন৷
দাঊদ (আ) বছরে ৬ মাসই রোজা রাখতেন৷ ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রোযাসমূহের মধ্যে দাঊদ (আঃ)-এর রোযা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। তিনি এক দিন রোযা রাখতেন এবং পরবর্তী দিন রোযা রাখতেন না। আল্লাহর নিকট দাঊদ (আঃ)--এর সালাত অধিক প্রিয়। তিনি রাতের অর্ধাংশ ঘুমাতেন, এক-তৃতীয়াংশ সালাতে কাটাতেন এবং আবার এক-ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। (ইবনে মাজাহ-১৭১২)
আরববাসীরা রমজানের রোজার পূর্বে আশুরার রোযা রাখত৷ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হিজরত করে) মদিনায় পৌঁছে ইহূদীদের রোযা অবস্থায় দেখতে পেয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন : এটা কী? তারা বললো, এ দিনে আল্লাহ্ মূসা (আঃ)--কে মুক্তি দেন এবং ফিরাউনকে ডুবিয়ে মারেন। তাই মূসা (আঃ)- এ দিন শোকরানা রোযা রাখেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : আমরা মূসা (আঃ)--এর (অনুসরণের) ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। তারপর তিনি এদিনে রোযা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন।( বুখারী-১৫৯২,মুসনাদে হাম্বল:৬খন্ড,পৃ-২৪৪৷
ইহুদীদের সাথে যাতে সাদৃশ্য না হয় তাই নবীজী আশুরার ২টি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন৷ অথচ একদল লোক বর্তমানে কারবালার শহীদদের স্মরণে আশুরার রোযা রেখে থাকেন৷যা ভিত্তিহীন৷
সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াত নাযিলের পর আশুরার রোযা ও আইয়্যামে বিয(প্রতি চন্দ্র মাসের ১১,১২,ও ১৩ তারিখ) এর রোযা পালনের ফরযিয়্যাত মানসুখ হয়৷তবে আশুরার ২ রোযা(মহরমের ৯,১০ অথবা ১০,১১) বর্তমানে সুন্নত৷ এ রোযার গুরুত্ব অনেক৷ আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আশূরার দিনের রোযার দ্বারা আমি আল্লাহর নিকট বিগত বছরের গুনাহ মাফের আশা রাখি।(ইবনে মাজাহ-১৭৩৮) এছাড়া অপর হাদিসে আশুরার রোযা কে রমযানের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা বলে ঘোষণা করা হয়েছে৷
হযরত আদম (আ) থেকে ঈসা (আ) এর সময় পর্যন্ত বিভিন্ন রোযা সমূহের বিধানগুলো হাদিস থেকে জানা যায়৷ বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্বাস (রা.) এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, আগে রোজা ছিল এক সন্ধ্যা থেকে আরেক সন্ধ্যা পর্যন্ত। রাতে ঘুমানোর পরে পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ করা বৈধ ছিল না।
মুসনাদে আহমদে এসেছে-মুয়াজ বিন জাবাল (রা) বলেন- নামাজ ও রোযা তিনটি অবস্থায় পরিবর্তিত হয়েছে৷রোযার তিনটি পরিবর্তিত অবস্থা নিম্নরূপ: ক.রাসূল (স) যখন মদিনায় আগমন করেন তখন তিনি প্রতি মাসে ৩টি করে ও আশুরার রোযা রাখতেন৷ অতপর كتب عليكم ا لصيام নাযিল করে রমযানের রোযা ফরয করা হয়
খ. প্রথমদিকে নির্দেশ ছিল- যে চাইবে রোযা রাখবে এবং যে চাইবে রোযার পরিবর্তে মিসকীনকে ভোজ্য দান করবে৷অতপর নাযিল হয়-فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
অর্থ-কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা'আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর। [ সুরা বাকারা ২:১৮৫ ]
গ.রমযানের পূর্ব রাত্রে নিদ্রা যাওয়ার আগে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস বৈধ ছিল বটে কিন্তু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রাত্রির মধ্যে জেগে উঠলে পানাহার ও সহবাস তার জন্য নিষিদ্ধ ছিল ৷ অতপর একদা সরম নামক এক আনসার সাহাবী (রা) সারাদিন কর্ম করে ক্লান্ত অবস্থায় রাত্রে বাড়ি ফিরে আসে এবং এশার নামাজ আদায় করেই ঘুমিয়ে পড়েন৷পরদিন পানাহার না করেই রোযা রাখেন। কিন্তু তাঁর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় রাসূল (স) তাকে এ অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। অন্যদিকে ওমর (রা) ঘুমিয়ে যাওয়ার পর জেগে ওঠে স্ত্রী সহবাস করে বসেন৷অতপর বিষয়টি রাসূল (স) এর নিকট অত্যন্ত পরিতাপের সাথে উপস্থাপন করে স্বীয় দোষ স্বীকার করেন৷তখন আল্লাহ পাক নাযিল করলেন-
نِسَآئِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ عَلِمَ اللّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ فَالآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُواْ مَا كَتَبَ اللّهُ لَكُمْ وَكُلُواْ وَاشْرَبُواْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّواْ الصِّيَامَ إِلَى الَّليْلِ وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
-অর্থ:রোযার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্নপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরন কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া
এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াত সমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে। [ সুরা বাকারা ২:১৮৭] আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে রমযানের প্রতিটি রোযা যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দিক৷ আমীন৷
লেখক: মো: খোরশেদ আলম সৌরভ
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১০ম ব্যাচ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ।