‘পটেনশিয়াল খুনিকে জামিন দিলে খুনের দায়-দায়িত্ব বিচারকের ওপর পড়ে কিনা বিবেচনা করা উচিত’
একজন ভয়ঙ্কর ব্যক্তি যিনি জামিনে পেয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যারা নায়ক আছে, তাদের উপর হামলা করতে পারেন— এই ধরনের জামিন যখন হয় তখন আমরা প্রচণ্ড শঙ্কিত, আতঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন বোধ করি। আমাকে পটেনশিয়ালি খুন করতে পারে এমন একজনকে যদি কোন বিচারক জামিন দেন, তাহলে এই খুনের দায় দায়িত্ব উনার ওপর পড়ে কিনা সেটা উনাদের বিবেচনা করা উচিত। বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) বিকেলে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এসব কথা বলেছেন।
বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসর গ্রহণ করবেন। ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার তার শেষ কর্মদিবস।
সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জাতির অত্যন্ত সন্ধিক্ষণে ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যে প্রত্যাশা, সেটা পূরণ করার জন্য বিচার বিভাগীয় যে সংস্কারগুলো ছিল, সে সংস্কারগুলোর ক্ষেত্রে তিনি অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যে আইনগুলো করেছি, সবকিছুর পেছনে উনার সমর্থন ছিল। আমাদের বিভিন্ন সময় যে বিভিন্ন কনসার্ন ছিল, ব্যক্ত করেছি।
সাক্ষাৎকালে অস্বাভাবিক জামিন প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতিকে জানিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাইকোর্টের কোনো কোনো বেঞ্চ অস্বাভাবিক জামিন দিয়ে দিচ্ছে। এটা নিয়ে আমি আমার কনসার্নের কথা প্রধান বিচারপতিকে এর আগে দেখা করে জানিয়েছিলাম। আজকেও জানিয়েছি। আজকে আপনাদেরকে প্রকাশ্যে বলে গেলাম। এর আগে যতবার দেখা হয়েছে, উনাকে বলেছি আমি। উনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিছু। যে বেঞ্চগুলো থেকে চার ঘন্টায় ৮০০ মামলায় জামিন দেওয়া হয়েছিল, তিনি তাদেরকে ডেকেও পাঠিয়েছিলেন। উনি উনার মত ব্যবস্থা নিয়েছেন। তারপরও এই জামিনের প্রকোপ কিছুটা কমেছে, কিন্তু এখনও অব্যাহত আছে।
তিনি আরও বলেন, একজন ভয়ঙ্কর ব্যক্তি, যিনি জামিনে পেয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যারা নায়ক আছে, তাদের উপর হামলা করতে পারেন— এই ধরনের জামিন যখন হয় তখন আমরা প্রচণ্ড শঙ্কিত, আতঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন বোধ করি। কিন্তু আমরা আইন মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়ের হাইকোর্টের উপর কোনরকম কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা না। হাইকোর্টের অভিভাবক হচ্ছেন প্রধান বিচারপতি। উনার কাছে আগেও এ ব্যাপারে উৎকণ্ঠা জানিয়েছিলাম। আজকে আবারও জানিয়েছি।
প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ড. আসিফ নজরুল বলেন, নতুন যে প্রধান বিচারপতি আসবেন, উনার সাথে আমার প্রথম যখন মিটিং হবে সেখানে আমি উনাকে বলব যে ভারতে পলাতক ফ্যাসিস্ট নেত্রী শেখ হাসিনা একের পর এক আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানকারীদের হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন এবং তার দলের অনুসারীরা যদি জামিন পায়, এটা জামিনের কোন নিয়ম নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ আমাকে পটেনশিয়ালি খুন করতে পারে এমন একজনকে যদি কোন বিচারক জামিন দেন, তাহলে এই খুনের দায় দায়িত্ব উনার উপর পড়ে কিনা সেটা উনাদেরকে বিবেচনা করা উচিত।
তিনি বলেন, সরি আমি এইভাবে বলছি, এটা এভাবে বলা ছাড়া উপায় নাই। কারণ পরিস্থিতি এমন একটা দিকে গিয়েছে যে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করার জন্য আমাদের যেকোন এক্সটেন্টে, যাকে যা বলার এটা আমার বলতে হবে। আমি আপনাদেরকে কথা দিচ্ছি, আমাদের যে নতুন প্রধান বিচারপতি থাকবেন, ওনার সাথে প্রথম মিটিংয়েও আমি এই ব্যাপারে বলব। যে সমস্ত ক্ষেত্রে আইনগতভাবে জামিন প্রাপ্য অধিকার, সেটা জামিন দিবেন বিচারকরা। অবশ্যই দিবেন। কিন্তু যে অপরাধী বা যে ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়ে আপনাকে-আমাকে খুন করতে পারে বলে আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সে তো জামিন পেতে পারে না। আমরা এই ব্যাপারে উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আমি উনাকে (প্রধান বিচারপতি) বলেছিলাম যে সংস্কারগুলো টেকসই করে রাখার জন্য উনার রিটায়ারমেন্টের পরও আমরা উনার কাছে আসব, উনার পরামর্শ নিব। উনি অত্যন্ত সানন্দে সম্মতি জানিয়েছেন, উনি আমাদেরকে যখন যা বুদ্ধি লাগে, পরামর্শ লাগে, সে ব্যাপারে হেল্প করবেন। আমি মনে করি যে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কোয়ালিফাইড এবং সবচেয়ে সৎ একজন প্রধান বিচারপতিকে আমরা পেয়েছিলাম। এটাও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটা অর্জন। আগামীতেও এরকম দক্ষ অভিভাবকের নেতৃত্বে বিচার বিভাগে যে সমস্ত অনিয়ম আছে বা যে সমস্ত ব্যাপারে প্রশ্ন আছে, সেগুলো দূর করার ব্যাপারে কাজ করে যাব।
সুপ্রিম কোর্টে বার কাউন্সিলের অনুষ্ঠানে অ্যাডভোকেট মাহবুব উদ্দিন খোকন জামিন প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে যে ভাষণ দিয়েছেন, সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আপনারা সাংবাদিক, আপনারা ইনভেস্টিগেট করে দেখেন। চার ঘন্টায় ৮০০ কেসে জামিন দিয়েছেন, মানুষের পক্ষে সম্ভব কিনা এটা করা? এটাতে যারা যারা আইনজীবী ছিলেন, আপনারা নিজেরা ইনভেস্টিগেট করে দেখেন। অধস্তন আদালতেও কিছু কিছু জামিন হয়েছে, সেটা উচ্চ আদালতের তুলনায় খুবই কম।
তিনি আরও বলেন, আমি বলতে চাই, যে জামিন হয় সেটার কমপক্ষে ৭০-৮০ শতাংশ উচ্চ আদালতে হয়েছে। অধস্তন আদালতে এই ধরনের জামিনের পর আমরা কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ অভিযোগপত্রে এবং ফরওয়ার্ডিংয়ে বা মামলার কোনো কাগজে কার বিরুদ্ধে মামলা, তার দলীয় পরিচয় উল্লেখ করে না। একই সাথে যে কথিত অপরাধটা আছে, সে অপরাধের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা কি, সে ধরনের কোনো তথ্য দেয় না। যদি অভিযোগপত্রের মধ্যে থাকে যে এই অপরাধটা করার সময় মিটিংয়ের মধ্যে ওই ব্যক্তি উপস্থিত ছিল বা তার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বা তার ভিডিও কনফারেন্সে বা তার ই-মেইলের মধ্যে এই তথ্য পাওয়া গেছে, তখন বিচারকের পক্ষে স্কোপ থাকে বুঝার যে তাকে কি জামিন দিবে কি দিবে না। যখন এই ধরনের কোনো তথ্য না থাকে, গড়পরতা তথ্য থাকে এবং ফরওয়ার্ডিংয়ের মধ্যে কোনো পরিচয় উল্লেখ করা না থাকে, সে সমস্ত ক্ষেত্রে অধস্তন আদালতে কিছু জামিন হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা এই ব্যাপারে পুলিশের সাথেও কথা বলেছি, জামিন নিয়ে যে বাণিজ্য চলছে, জামিন নিয়ে যে অরাজকতা চলছে, সেটা বন্ধ করার জন্য পুলিশকেও আমাদের সাথে কাজ করতে হবে। পুলিশ অনেক ক্ষেত্রেই করছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে করছে না। সে সমস্ত ক্ষেত্রে আমরা পুলিশের কাছেও আমাদের উদ্যোগের কথা জানিয়েছি। আমরা তারপরও আপনাদেরকে আবারও বলতে চাই, আমরা স্বাভাবিক জামিন যেটা, যেই জামিন একটা অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রাপ্য— সেটার ব্যাপারে আমাদের কথা নাই। কিন্তু একজন নেত্রী অন্য একটা দেশে পালিয়ে গিয়ে তার দলের ক্যাডারদের বলছে জুলাই গণভুত্থানে যারা কর্মী আছে তাদেরকে হত্যা করার জন্য, তারপরে তার দলের অনুসারী সন্ত্রাসীদের কেউ জামিন দিয়ে দিবে, এটা কোনো আইনে এক্সেপ্টেবল না। কোন নৈতিকতায় এক্সেপ্টেবল না। এ ব্যাপারে আমরা ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে আরো শক্তভাবে, আরো কালেক্টিভলি কাজ করব।
২৬তম প্রধান বিচারপতি কে হবেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন এটা হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়। এই নীতিনির্ধারণী বিষয়ে এককভাবে কোনো কিছু বলার এখতিয়ার আমার নাই। তবে হয়তো তিন চার দিনের মধ্যে জানতে পারবেন।