বঞ্চনার শিকার বিসিএস ক্যাডার শিক্ষকরা

বিধি এক ভিন্ন প্রয়োগ, ৫০ বছর পেরিয়েও প্রভাষক ২৩ শিক্ষক

বিধি এক ভিন্ন প্রয়োগ: ৫০ বছর পেরিয়েও প্রভাষক ২৩ শিক্ষক
বিধি এক ভিন্ন প্রয়োগ: ৫০ বছর পেরিয়েও প্রভাষক ২৩ শিক্ষক  © ফাইল ফটো

কেউ ১৩তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন, কেউবা ১৪তম কিংবা ১৬তম বিসিএসে। বহু আগে বয়স ৫০ বছর পেরিয়েছে, চাকরিও শেষ দিকে। তাঁদের ব্যাচের অনেকে অধ্যাপক, এমনকি অধ্যক্ষ পর্যন্ত হয়ে গেছেন, অথচ সরকারি কলেজের মেধাবী এসব শিক্ষকরা রয়ে গেছেন প্রভাষক পদেই। তাঁদের একটিও পদোন্নতি হয়নি, পাননি উচ্চতর গ্রেড। বিভাগীয় পরীক্ষা সম্পন্ন করতে না পারার অজুহাতে আটকে রাখা হয়েছে তাদের পদোন্নতি। যদিও বিভাগীয় পরীক্ষা সম্পন্ন না করলেও ৫০ বছর পূর্তিতে স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির বিধান রয়েছে। ​ফলে বিসিএস উত্তীর্ণ এসব শিক্ষকরা চাকরির শেষ সময়ে এসে স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি না হওয়ায় চরম মানসিক যন্ত্রণা ও হতাশার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১ এর ৮(১) (এফ) বিধি অনুসারে, ৫০ বছরের বেশি বয়সী সরকারি কর্মকর্তাদের স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির জন্য শর্ত শিথিলের বিধান রয়েছে। এ তেবলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তির পঞ্চাশ বৎসর বয়স পূর্ণ হইলে বিধি-৫ এর (বি) অনুচ্ছেদের শর্ত হইতে অব্যাহতি পাইবেন।’ বিধি-৫ এর বি অনুচ্ছেদের শর্ত অনুযায়ী, বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস ও বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। ১৯৮১-এর অনুচ্ছেদ ৮(১) এর এফ বিধি অনুসারে বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হলে এ দুটো শর্তই শিথিলের বিধান থাকলেও অজ্ঞাত কারণে বঞ্চিত করা হচ্ছে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত অন্তত ২৩ জন শিক্ষককে।

১৬তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত  লক্ষ্মীপুর সরকারি রামগঞ্জ কলেজের স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতিবঞ্চিত দর্শনের প্রভাষক মুহাম্মদ আব্দুস শহীদ দুঃচিন্তা ও হতাশায় স্ট্রোক করে মানসিক প্রতিবন্ধির ন্যায় করুণ ও অসহায় জীবনযাপন করছেন।

স্বামীর অকালমৃত্যু ও নানাবিধ শারিরীক সমস্যায় জর্জরিত চট্টগ্রাম হাজী মুহম্মদ মহসীন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক নায়লা জামিল আবেদনে জানান, ‘বয়স ৫০ বছরের অধিক হওয়ার পরেও আজ পর্যন্ত আমার চাকরি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি হয়নি। যার দরুণ আমি চরম হতাশার মাঝে দিন কাটাচ্ছি। এতোকাল পর্যন্ত প্রভাষক পদে অবস্থান করায় মানসিক ও সামাজিকভাবে ভীষণ হেয় ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি। অন্যদিকে আর্থিকভাবেও অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আসছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮১-এর অনুচ্ছেদ ৮(১) এর এফ বিধি অনুসারে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের অনেক শিক্ষককে চাকরির ৫০ বছর পূর্তিতে এমনকি আত্তীকৃত অনেক কলেজের প্রভাষককে স্থায়ীকরণ করে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তবে এক অজানা কারণে ৫০ বছর পেরোনো এই ২৩ শিক্ষক বারবার আবেদন করেও পদােন্নতি পাননি। পদোন্নতি বঞ্চিত এসব শিক্ষকদের অভিযোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার ভুল ব্যাখ্যার কারণে তাদের পদােন্নতি হচ্ছে না। এসব কর্মকর্তার অসহযোগিতার কারণে মৃত্যুর আগে নিজের স্থায়ীকরণ দেখে যেতে পারেননি, মৃত্যুর পর স্থায়ীকরণ করা হয়েছে এমন নজিরও আছে!

শুধু তাই নয়, তেমন কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ পাওয়া অসংখ্য আত্মীকৃত কলেজ শিক্ষককে ৫০ বছর পূর্তিতে স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২৩ অক্টোবর ২০১৭ এর একটি আদেশেই স্থায়ীকরণ করা হয় ৩৮৩ জন আত্মীকৃত শিক্ষককে। স্থায়ীকরণের পর পদোন্নতি পেয়ে অনেকেই অধ্যাপক, এমনকি অধ্যক্ষ পর্যন্ত হয়ে গেছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রেরিত চিঠিতে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত ৬ জন কর্মকর্তা এবং ১০% কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বয়স ৫০ বছরের বেশি হওয়ায় সুপারিশসহ চাকরি ভূতাপেক্ষভাবে স্থায়ীকরণের তথ্যসম্বলিত তালিকা প্রেরণ করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে এ তালিকায় ছিলেন ১৩তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক শেখ মো. মুয়াহহিদুল হক (আইডি নং-৩০০৪), ১৪তম বিসিএসের ঝিনাইদহ কেসি কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক ফাহমিদা খাতুন (৬৫৪২), চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক নায়লা জামিল (২৭৮৫) এবং ১৬তম বিসিএসে নিয়োগপ্রাপ্ত ঢাকার শহীদ বেগম শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিব সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক শাহানা পারভীন (১৮১০৯), টাঙ্গাইল সরকারি সা’দত কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মো. আজিজুর রহমান (৫০৮৭) এবং লক্ষ্মীপুর সরকারি রামগঞ্জ কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক মুহাম্মদ আব্দুস শহীদ (৯২৫৪)। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে ১০% কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকায় ছিলেন আরও ১১ জন কর্মকর্তা। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ (১০৩০১), শাহজাহান আলী (৪৯৯০), মো. শাহ আলম (২৫৪৫), মো. শহীদুল ইসলাম (১০৪১২), ড. মো. আব্দুস সবুর খাঁন (৯৬৭৩), জয়দেব সজ্জন (৯৪৯৭), পরাগ কান্তি দেব (৪০১৫), মো. কালিমুল্লাহ (১০৯৪৮), মো. নাসিম হায়দার (৩৫০), ড. মো. আব্দুল মান্নান (১০২৩০) এবং ড. বি. এম রেজাউল করিম (৯৬৮৭)।

এই ১৭ জন কর্মকর্তা ছাড়াও পরবর্তীতে স্থায়ীকরণের নিমিত্তে আবেদনকৃত আরও ৫ জন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তার নাম মাউশি কর্তৃক এ তালিকায় যুক্ত হয়। তাঁরা হচ্ছেন ১৪তম বিসিএসের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক মো. ইকবাল (৪৯৪৪), ১৬তম বিসিএসের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক মাহফুজা আক্তার (১০৮৬), শেখ মো. আ: সালাম (৭৫৭০), হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. মাহতাব হোসেন (৫৫৪৬)। এছাড়া ১৬তম বিসিএসের দর্শন বিভাগের প্রভাষক শাহীন পারভীন (০০০০৫২১৯)-সহ আরো অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তাই একাধিকবার আবেদন করেও অদ্যাবধি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতিবঞ্চিত।

গত বছরের ৮ জুন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে প্রভাষক পদ থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির বিষয়ভিত্তিক খসড়া তালিকায় উপরোক্ত শিক্ষকদের নাম থাকলেও ডানপাশে মন্তব্য কলামে ‘চাকরি স্থায়ীকরণ হয়নি’ বলে উল্লেখ করা হয়। ভুক্তভোগী এসব শিক্ষকদের বয়স ৫০ বছরের উর্ধ্বে হওয়ায় ১৯৮১ এর ৮(১) (এফ) বিধি মোতাবেক মন্তব্য কলাম সংশোধনপূর্বক চাকরি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষে কয়েক দফা আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।

১৬তম বিসিএসে ১৬তম স্থান অধিকারী মো. আজিজুর রহমানের বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে ২০১৭ সালের ৯ মে । জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) ৫৪তম ব্যাচে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন তিনি। স্ত্রীর দীর্ঘকালীন অসুস্থতা এবং ১ বছর বয়সী কন্যাশিশু রেখে অকালমৃত্যুসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিভাগীয় পরীক্ষা সমাপ্ত করতে পারেননি তিনি। ১৯৮১ এর ৮(১) এফ বিধি অনুসারে বেশ কয়েকবার চাকরি স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাননি দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ সততা, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা সহকারে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানসহ সুষ্ঠুভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে আসা এ সরকারি কলেজ শিক্ষক।

মানিকগঞ্জ সরকারি ভিকু মেমোরিয়াল কলেজের ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক মাহফুজা আক্তার ও চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক শেঃ মো. মুয়াহ্হিদুল হক আবেদনে জানান, গুরুতর শারীরিক অসুস্থতাসহ নানাবিধ সমস্যা-সংকটের কারণে তিনি বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। মাউশি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা বিভাগে একাধিকবার সরাসরি যোগাযোগ করলে কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের চাকরি স্থায়ীকরণ হবে বলে আশস্ত করা হয়। কিন্তু বয়স ৫০ বছরের উর্ধ্বে হওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি তাঁদের চাকরি স্থায়ীকরণ হয়নি।

মানিকগঞ্জ সরকারি ভিকু মেমোরিয়াল কলেজের ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক মাহফুজা আক্তার, ঢাকার শহীদ বেগম শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিব সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক শাহানা শারমিনসহ অনেক বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত ও দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। চাকরির শেষ বয়সে এসেও স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি না হওয়ায় চরম হতাশা নেমে এসেছে এসব শিক্ষক পরিবারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী, শিক্ষাসচিব, মাউশির মহাপরিচালকের সুদৃষ্টি, মানবিক বিবেচনা ও আশু সমাধান কামনা করেছেন পদোন্নতিবঞ্চিত সরকারি কলেজের এসব শিক্ষক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জানান, এ বিষয়ে কোনো গাফিলতি হয়ে থাকলে সেটি তদন্ত করা হবে।  এই ২৩ শিক্ষকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে আইনগত কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেটি সমাধানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সহযোগিতা নেয়া হবে।


সর্বশেষ সংবাদ