শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত ৪ কোটি ২০ লাখ শিশু
কোভিড-১৯ এর কারণে স্কুলগুলো বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটি ২০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এতে করে দূরশিক্ষণের উপর নির্ভর করা ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছে আর কোনও উপায় নেই। তবে, শিক্ষার্থীদের অনেকেরই ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা নেই এবং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল ক্লাসকে তাদের প্রত্যাশা এবং শেখার চাহিদার তুলনায় কম বলে মনে করছে।
ইউনিসেফের সাথে সাম্প্রতিক এক ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় বাংলাদেশের আটটি বিভাগের প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষার্থীরা সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছে যে, দূরশিক্ষণ যদিও তাদেরকে পাঠ্যক্রমের সংস্পর্শে থাকতে সহায়তা করে, তবে এক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী নিশাত তাহিয়া প্রমি জানায়, ‘শ্রেণিকক্ষের তুলনায় অনলাইন শিক্ষায় প্রয়োজনীয় একাডেমিক দিকনির্দেশনা, মূল্যায়ন এবং মতামত আদান প্রদানের অভাব রয়েছে। দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ, ডেটা শেষ হয়ে যাওয়া এবং বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারনে আমাদের ক্লাস প্রায়শই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
স্কুলগুলো দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এবং শিশুদের পড়াশোনা, তাদের কল্যাণ ও ভবিষ্যতের উপর যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, সেগুলো নিয়ে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে।
বিষয়টি উল্লেখ করে ১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী তাজবীর জিহাদ সৈকত জানায়, ‘দূরশিক্ষণ কখনও অব্যাহত শিক্ষা কার্যক্রমের সমাধান হতে পারে না। স্কুল কেবলমাত্র একাডেমিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র নয়, বরং এটি সহ-পাঠ্যক্রমিক বহুবিধ কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রও বটে। প্রযুক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে আমরা দ্রুত আমাদের সামাজিক দক্ষতা এবং প্রতিভা হারাচ্ছি।’
মহামারী চলাকালীন স্কুলগুলো পুনরায় চালু হওয়া এবং পরীক্ষাগুলো পুনরায় শুরু হওয়ার বিষয়ে গুজব ও অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থীদের উদ্বেগের একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোসাদ্দেক বিল্লাহ জিতু (১৭) জানায়, ‘এ বিষয়গুলোতে সরকারের সুস্পষ্ট প্রকাশ্য ঘোষণা দেওয়া উচিত, যাতে করে বিভিন্ন সংবাদ-উৎস থেকে প্রাপ্ত ভুল তথ্যের মাধ্যমে আমরা বিভ্রান্তিতে না পড়ি।’
ফোকাস গ্রুপে অংশগ্রহণকারী সবাই এ বিষয়ে একমত যে, গ্রামীণ অঞ্চল এবং আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের মাধ্যমে দূরশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পারছে না। কারণ, এসব ডিভাইস ব্যবহার করার সুযোগ অনেকেরই নেই।
ইউনিসেফ-আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশের স্কুল-বয়সী শিশুদের ৬৩ শতাংশের বাড়িতে ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। এই ফলাফল ডিজিটাল বৈষম্য বন্ধ করা এবং অন্তর্নিহিত অসমতা মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয় যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে এবং আন্তঃপ্রজন্ম দারিদ্র্যের চক্রকে স্থায়ী রূপ দেয়।
শিক্ষার্থী ইয়াদ মোহাম্মদ জানায় (১৭) জানায়, ‘মহামারী চলাকালীন বহু পরিবারের আয়-রোজগার কমে গেছে। কিছু বাবা-মা তাদের সন্তানের পড়াশোনা আর আগের মতো চালিয়ে নিতে সহযোগিতা করতে পারছে না। দিন আনে দিন খায় এরূপ পিতামাতার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও কঠিন।’
দূরশিক্ষণকে সবার জন্য আরও উন্মুক্ত করতে ইন্টারনেট ডেটার শুল্ক কমিয়ে শিক্ষণ প্ল্যাটফর্মগুলোর বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী জাতীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত শিক্ষণ কার্যক্রমের মানের প্রশংসা করেছে এবং সকল শিক্ষার্থী উপকৃত হয় এমনভাবে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষন মডিউলগুলো বর্ধিত করার পরামর্শ দিয়েছে।
মহামারীর শুরু থেকেই টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনসহ একাধিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শিক্ষার সকল ধারা যেমন, আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক, ধর্মীয় ও কারিগরি শিক্ষাকে একত্রিত করে দূরশিক্ষণের কৌশল প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়নে ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করেছে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিক্ষা-বিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে এবং দূরশিক্ষণে আরও ন্যায়সঙ্গত সুযোগ তৈরি করতে ইউনিসেফ স্মার্ট ফোনের পরিবর্তে বেসিক মোবাইল ফোন এবং টেক্সট বার্তা ব্যবহার করে শেখার সুবিধা দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে, কিছু সংখ্যক শিশুর বেসিক মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় আমরা প্রায়শই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে থাকি। এসব শিশুর দোরগোড়ায় একটি মুদ্রিত শিক্ষণ প্যাকেজ পৌঁছে দিতে ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করছে। এর উদ্দেশ্য হলো কোনও শিশু যেন পিছনে পড়ে না থাকে।’
ইউনিসেফ বলছে, বিশ্বজুড়ে শিশু এবং তরুণদের জন্য ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে আনতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মহামারী শুরুর আগেও ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল ও আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বড় সংখ্যক তরুণ-তরুণীদের হস্তান্তরযোগ্য, ডিজিটাল এবং উদ্যোক্তা হওয়ার দক্ষতা শিখতে হবে।
গিগা উদ্যোগের মাধ্যমে, ইউনিসেফ এবং আইটিইউ-এর লক্ষ্য হলো শিশু ও তরুণ-তরুণীদের মানসম্মত ডিজিটাল শিক্ষার সমান সুযোগ তৈরি করে দিয়ে শিক্ষার সঙ্কট মোকাবেলা করা এবং শিক্ষার রূপান্তর ঘটানো। এছাড়াও এর সামগ্রিক লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রতিটি স্কুলকে ইন্টারনেটে সংযুক্ত করা এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তথ্য, সুযোগ-সুবিধা এবং নিজ নিজ আগ্রহের কাজের সাথে সংযুক্ত করা।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিক্ষার প্রধান নূর শিরিন মোঃ মোক্তার বলেন, ‘আমরা যেহেতু আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে বিস্তৃত করছি, সেহেতু অবশ্যই আমাদের শিশু এবং তরুণ-তরুণীদের কথা শুনতে হবে যাতে করে অনলাইনে হোক বা ব্যক্তিগতভাবে হোক আমরা ক্রমাগতভাবে আমাদের শিক্ষার মান উন্নত করতে পারি। এক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীরাই আমাদের সেরা শিক্ষক।’