নতুন বছরে ‘স্কুল ফিডিং’ প্রকল্প চালু নিয়ে শঙ্কা, শিক্ষক-অভিভাবকদের হতাশা
প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি) আওতায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত ও প্রাথমিক থেকে ঝরে পড়া রোধে ২০০১ সালে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের বিস্কুট দিয়ে শুরু হয় এই প্রকল্প। তবে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে চালানো হলেও মেয়াদ শেষ হওয়ায় বর্তমানে এই কর্মসূচি স্থগিত আছে। নতুন করে কবে সেটি পুনরায় চালু হবে, এটি নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা ।
সোমবার (০৪ নভেম্বর) প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এ প্রসঙ্গে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্কুল ফিডিং কর্মসূচির প্রস্তাবনা এখনো মন্ত্রণালয়ে যায়নি। কবে নাগাদ প্রস্তাব পাস হয়ে আসবে সেটিও জানা নেই সংশ্লিষ্টদের। বিষয়টি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
তারা জানান, প্রান্তিক পর্যায়ে শিশুদের অনেক সময় খাবার না খেয়েই বিদ্যালয়ে চলে আসতে হয়। এটার দুটি কারণ, প্রথমত অর্থনৈতিক সংকট দ্বিতীয়ত অভিভাবকদের অসচেতনতা। স্কুলে খাবার পেলে বাচ্চারা যেতে আগ্রহী হত। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় পুনরায় কবে শুরু হবে সেটা কারোর জানা নেই।
এর আগে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নতুন প্রকল্প ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল সরকারের। এটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে হবে। কারিগরি সহায়তা দেবে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। শিক্ষক ও অভিভাবকদের পরামর্শে বিস্কুটের একঘেয়েমি কাটাতে ডিম, বিস্কুট, ইউএইচটি (আলট্রা হাই টেম্পারেচার) দুধ, পাউরুটি ও বিভিন্ন মৌসুমি ফল থাকবে ফিডিং প্রকল্পের খাবারে। সপ্তাহের পাঁচ দিন যেকোনো দুটি পদ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে।
অবশিষ্ট জেলাগুলোতে আলাদা একটা নতুন প্রজেক্ট শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এখনো মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবনা অনুমোদন হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে দ্রুত সময়ে প্রস্তাবনা অনুমোদন হলে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারি— আবু নূর মোঃ শামসুজ্জামান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তিন বছর মেয়াদি নতুন প্রকল্পের আওতায় দেশের ৬২ জেলার ১৫০টি উপজেলায় ফিডিং প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। ২১ হাজার ১৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক–প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৩৪ লাখ ৬২ হাজার ৩৮০ শিক্ষার্থী এর আওতায় থাকবে।
প্রকল্পটি সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে বলে গত ৭ জুলাই সিদ্ধান্ত হয়। আগে শুধু বিস্কুট দেওয়ায় প্রতি শিশুর জন্য খরচ হতো ১৮ থেকে ১৯ টাকা। নতুন প্রকল্পে খাবারের পরিমাণ বাড়ায় মাথাপিছু খরচ ধরা হয়েছে ২৮ টাকার মতো। এর সঙ্গে আরও সাত টাকার মতো যোগ হবে খাবার প্রক্রিয়া, পরিবহণ ও সরবরাহের খরচ। প্রথম ছয় মাস শুধু বিস্কুট দেওয়া হবে। পরের আড়াই বছর দেওয়া হবে দুই পদ করে খাবার।
আরও পড়ুন: ভাইভা না দিয়েও প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক পদে চাকরি!
নতুন প্রকল্পের বিষয়ে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়েছিল। পরে ২৩ জুন আরেকটি সভা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ আগস্ট ও ৫ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে অধিদপ্তরের প্রকল্প পর্যালোচনা সভা হয়।
২০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় কমিয়ে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। তবে বিভিন্ন সময় আলোচনা–পর্যালোচনা আর সংশোধন হলেও শিশুদের জন্য জরুরি এই প্রকল্প নতুন করে কবে চালু হচ্ছে? বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য দিতে পারেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক পরিবার আছে, যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নেই। বাচ্চাদের খাবারের বিষয়ে তাদের সচেতনতা থাকলেও সামর্থ্য থাকে না। স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা থাকলে বাচ্চারাও আগ্রহী হয়ে স্কুলে আসে আবার অভিভাবকরাও বাচ্চাদের পাঠাতে আগ্রহী থাকেন। আর খাবারের ভিন্নতা থাকলে এই আগ্রহের পরিমাণ আরও বাড়বে। এই প্রকল্পটা যত দ্রুত সম্ভব পুনরায় চালু করার প্রয়োজন— মো. আবু সাইদ, সহকারী শিক্ষক, বালুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রংপুর
কর্মসূচি পুনরায় চালুর বিষয়ে মত দিয়েছেন অভিভাবকরা। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবক কাণিজ ফাতেমার সঙ্গে কথা হলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গ্রামের বেশিরভাগ পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা থাকে না। সময়মতো বাচ্চাকে প্রস্তত করে স্কুলে পাঠানো এবং সাথে খাবার দেয়া, অন্য কাজের ভিড়ে এ বিষয়গুলো আমাদের তেমন খেয়াল করা হয় না।
ফিডিং কর্মসূচি থাকলে বাচ্চা না খেয়ে গেলেও অভিভাবক কিছুটা চিন্তা মুক্ত থাকেন। আর যাদের আর্থিক অবস্থা বেশি খারাপ, তাদের বাচ্চা খাবারের লোভে হলেও স্কুলে নিয়মিত যাবে। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়মিত উপস্থিতি বাড়াতে খাদ্য কর্মসূচি অনেক বেশি কার্যকর।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের বালুয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আবু সাইদের সাথে কথা হয় ফিডিং কর্মসূচির কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, এই প্রকল্পটা থাকলে বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের গভীর মনোযোগ তৈরি করা যেতো। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক পরিবার আছে, যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নেই।
তিনি বলেন, বাচ্চাদের খাবারের বিষয়ে তাদের সচেতনতা থাকলেও সামর্থ্য থাকে না। স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা থাকলে বাচ্চারাও আগ্রহী হয়ে স্কুলে আসে আবার অভিভাবকরাও বাচ্চাদের পাঠাতে আগ্রহী থাকেন। আর খাবারের ভিন্নতা থাকলে এই আগ্রহের পরিমাণ আরও বাড়বে। এই প্রকল্পটা যত দ্রুত সম্ভব পুনরায় চালু করার প্রয়োজন।
সরকারের তথ্যমতে ২০০১ সালে যশোরে প্রথমবার স্কুল ফিডিং প্রকল্প চালু করে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। সংস্থাটির সঙ্গে সরকার ২০১১ সালে যৌথভাবে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া ও টুঙ্গীপাড়া উপজেলায় স্কুল ফিডিং প্রকল্প শুরু করে। ধাপে ধাপে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। তবে কোভিডের সময় দীর্ঘ ১৮ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত চালানো হয়।
প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০২০ সালে মিড–ডে মিল (দুপুরের খাবার) প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ কাজের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শিখতে ৫০০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: নতুন বছরে ফের চালু হচ্ছে স্কুল ফিডিং প্রকল্প?
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খাদ্য কর্মসূচি শীর্ষক স্কুল ফিডিং প্রকল্পের সাথে জড়িত এক কর্মকর্তার সাথে কথা হলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সামগ্রিক পরিকল্পনার প্রস্তাবনা এখনো মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি।
মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর অনুমোদন হয়ে আসতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন। তারপরে মাঠপর্যায়ে এটার বাস্তবায়নের জন্য অনেকগুলো পর্যায় রয়েছে, সে অনুযায়ী ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরও সময় প্রয়োজন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। এই মুহূর্তে এরচেয়ে বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। প্রকল্প প্রণয়নের জন্য অনেক প্রস্তাবনা দেয়া হবে, সেটার মধ্যে কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য এবং সেটার পদ্ধতি কী হবে এমন বিষয়গুলো মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমাদের কাজ হলো ফাইল প্রস্তত করে পাঠানো।
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান দ্যা ডেইল ক্যাম্পাসকে বলেন, স্কুল ফিডিং কর্মসূচির একটা পার্ট বান্দরবান, কক্সবাজার জেলায় এবং ভাসানচরে শুরু হচ্ছে। এর বাইরে অবশিষ্ট জেলাগুলোতে আলাদা একটা নতুন প্রজেক্ট শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এখনো মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবনা অনুমোদন হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে দ্রুত সময়ে প্রস্তাবনা অনুমোদন হলে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারি।