নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন নয়, শিক্ষা কমিশন করতে হবে
মাধ্যমিকের নবম শ্রেণিতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা ইত্যাদি শাখা) বিভাজন না করার সুপারিশ করেছে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান। সংস্থাটি বলছে, নবম শ্রেণি থেকে বিশেষায়িত বিভাগ বিভাজন শিক্ষায় ও সমাজে বৈষম্য তৈরি করছে।
সংস্থাটি শিক্ষার বৈষম্য দূর করতে শিক্ষা কমিশন করাসহ প্রাক প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত নানা ধরনের প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, শিক্ষাব্যবস্থার পুরো কাঠামোর যুগোপযোগী রূপান্তর ঘটাতে হবে। আজ বুধবার (২ অক্টোবর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষায় নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তর: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেছে গণসাক্ষরতা অভিযান।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রস্তাবগুলোর সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। একই সঙ্গে লিখিত আকারে তৈরি বিস্তারিত প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। এসব প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কাছেও দেওয়া হবে বলে জানান রাশেদা কে চৌধূরী।
মাধ্যমিকে এত দিন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে অভিন্ন বিষয় পড়তে নবম শ্রেণিতে গিয়ে বিভাগ বিভাজন করতে হতো। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, চলতি বছর থেকে নবম শ্রেণিতে বিভাগ (বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা ইত্যাদি শাখা) বিভাজন তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিক্ষাক্রমের এ বিষয়সহ অনেক কিছু বাদ দিয়ে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আবারও মাধ্যমিকে বিভাজন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আজকের সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলা হয়, বিজ্ঞান শিক্ষার মৌলিক ধারণা লাভ সব শিক্ষার্থীর জন্য অপরিহার্য। কারণ, মানুষ বিজ্ঞান শেখে শুধু বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞান–সংক্রান্ত পেশাজীবী হওয়ার জন্য নয়; বরং সব শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা অর্জন করলে তার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা অর্জন করে। কিন্তু নবম শ্রেণি থেকে বিশেষায়িত বিভাগ বিভাজন শিক্ষায় ও সমাজে বৈষম্য তৈরি করছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় (২০২৩ সালের আগে) নবম শ্রেণির মোট শিক্ষার্থীর ৩০ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগের এসব শিক্ষার্থীর প্রায় ২০ শতাংশ উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বাণিজ্য বা কলা বিভাগে চলে যায়। তার মানে, প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান সম্পর্কে মৌলিক ধারণা অর্জন না করেই মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে। অন্যদিকে বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়া নবম শ্রেণির মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়েশিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ১৫ শতাংশ, যা ছেলেশিক্ষার্থীদের অর্ধেক। কাজেই নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন বড় ধরনের জেন্ডার বৈষম্যও তৈরি করছে।
তাহলে কোন শ্রেণি থেকে এই বিভাজন হওয়া উচিত বলে মনে করেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব দেন সংবাদ ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস এবং প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার গঠিত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মনজুর আহমদ। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, বিভাগ বিভাজন একাদশ শ্রেণিতে হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেটি হঠাৎ করে পরিবর্তন হলো। সেটি কীভাবে হলো, কেন হলো, শুধু আগের জায়গায় চলে গেল। সেটাই যেন মনে হচ্ছে মূল কথায়। ঢালাওভাবে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। এটি বিচার-বিবেচনা করে করা উচিত।’
অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, শিক্ষার জন্য একটি কমিশন করতে হবে। সেটি অন্যান্য কমিশনের জন্য তিন মাসের কমিশন হবে না। এখন তাৎক্ষণিকভাবে কী করা যায় এবং পরে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংস্কারের জন্য কিছু রূপরেখা তৈরি করে কীভাবে এগোনো যায়, সেই ধরনের চিন্তাভাবনা করতে হবে।
কিছুসংখ্যক পরীক্ষার্থীর দাবির মুখে এইচএসসির স্থগিত পরীক্ষা বাতিল করা, হঠাৎই ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি গঠন করে আবার তা বাতিল করাসহ কিছু বিষয়ের জন্য বিভ্রান্তি হচ্ছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, ‘আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, শিক্ষাকে অগ্রাধিকারে রাখা হয়নি। শিক্ষা “সাইডলাইনে” চলে গেছে।’ তিনি বলেন, শিক্ষার বৈষম্য ও বিভ্রান্তির দূর করতে কাজ করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী স্বপ্নকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরাও চেষ্টা করছেন।
আরও যত প্রস্তাব
সংবাদ ব্রিফিংয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষাকে খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্নভাবে দেখার আর সুযোগ নেই। বরং প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একটি সামগ্রিক ও নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তরিত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করে তা বাস্তবায়নের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দুই বছরের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষাকে যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক এবং বাধ্যতামূলক করে একে একটি স্বতন্ত্র কাঠামো হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষা বা বৃত্তি পরীক্ষার মতো পরীক্ষা চালু করা সংগত হবে না। শ্রেণিভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং স্কুলভিত্তিক বার্ষিক পরীক্ষার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রস্তুত ও আনুষঙ্গিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী রূপান্তর করে মূলধারায় সন্নিবেশ করা, বৈশ্বিক চাহিদাকে বিবেচনা করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য ‘ফাউন্ডেশনাল যোগ্যতা’ অর্জনের নির্দেশক নির্ধারণ এবং প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ও নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা রূপান্তর করতে হবে।
লিখিত প্রস্তাবে বলা হয়, সরকার অধিভুক্ত মাদ্রাসা বাদেও বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা মূলধারার শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে। তাদেরও একটি নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় এনে মূলধারার শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার মান ও শ্রমবাজারের দাবি অনুযায়ী শিক্ষার সংস্থান করতে হবে।
গণসাক্ষরতা অভিযান বলছে, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের প্রাথমিক কাজ হিসেবে ভর্তি পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। মুখস্থনির্ভর লিখিত পরীক্ষার বদলে প্রবণতানির্ভর পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও সক্ষমতা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এ ছাড়া শিক্ষা নিয়ে দুটি মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় নামে দুটি মন্ত্রণালয়) পরিবর্তে একক মন্ত্রণালয় করা, একটি জাতীয় শিক্ষা রূপান্তর কমিশন গঠন করা এবং ‘সমন্বিত জাতীয় শিক্ষক উন্নয়ন রূপরেখা’ করা এবং শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাত থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে রক্ষা করাসহ আরও কিছু প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। আর শিক্ষায় রূপান্তর নিশ্চিত ও টেকসই করতে জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ শিক্ষায় বিনিয়োগের সুপারিশ করেছে গণসাক্ষরতা অভিযান।
লিখিত প্রস্তাবে গণসাক্ষরতা অভিযান বলছে, গত জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে ও তাঁদের অপরিসীম ত্যাগে এক অভাবনীয় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে। রাষ্ট্রসংস্কারের অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ ব্যর্থ হতে দেওয়া যায় না।