বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ পুনর্মিলনীর অর্থ নয়-ছয়ের অভিযোগ
উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ। ভালো ফলাফলের কারণে দেশব্যাপী সুনাম রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় শিক্ষার মানও বেশ ভালো। প্রতিষ্ঠানটির ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সাবেক শিক্ষার্থীরা ‘উৎসবে ৪৫’ নামে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তবে এ আয়োজনকে ঘিরে আয়োজক কমিটির বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
গত ১৮ জুন উৎসবে ৪৫ নামে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জন অংশগ্রহণ করেন। তবে গভীর রাতে নারীদের বাসের ব্যবস্থা না করা, রাতের খাবার না দেওয়া, র্যাফেল ড্র’র নামে টাকা উত্তোলন করা হলেও তা আয়োজন না করা, ১২ কিলোমিটার রাস্তা যাতায়াতের জন্য দেড় লাখ টাকা বাস ভাড়া ব্যয় দেখানো হয়েছে। এমনকি পুনর্মিলনীর র্যালির জন্যও খরচ ধরা হয়েছে দেড় লাখ টাকা। এছাড়া অধিক মূল্যে খাসি ক্রয়, রিইউনিয়নের দিন টাকা নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করানো হলেও তার কোনো হিসাব না দেওয়া, কনসার্ট শুরুর আগে বহিরাগতদের কনসার্ট দেখার সুযোগ করে দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন পুনর্মিলনীতে অংশ নেওয়া সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা। অথচ অনুষ্ঠানের জন্য শিক্ষার্থী-অতিথিদের কাছ থেকে নেওয়া রেজিস্ট্রেশন ফি ও বিভিন্ন ধরনের স্পন্সর মিলিয়ে প্রায় কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
যদিও আয়োজক কমিটির দাবি, খাসির মাংসের ফ্রিজিং জনিত সমস্যার কারণে অনুষ্ঠানে রাতের খাবার সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এজন্য উপস্থিত সকলের কাছে তাৎক্ষণিক ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য অনিয়মের যে অভিযোগ তোলা হয়েছে সেগুলো ভিত্তিহীন। একটি মহল আয়োজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এমন খবর ছড়িয়েছে।
এ বিষয়ে আয়োজক কমিটির সদস্য তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কাচ্চির মাংস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রাতে খাবার দেওয়া সম্ভব হয়নি। রাতের খাবারের জন্য যে অর্থ বাজেট করা ছিল, সেটি খুব দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এছাড়া র্যাফেল ড্রয়ের অর্থও ফেরত দেওয়া হবে। আমরা সবকিছুর অডিট করবো। এজন্য আয়োজক কমিটির আহবায়ক সাদীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অডিট রিপোর্ট খুব দ্রুত প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
আয়োজক কমিটি ও অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, পুনর্মিলনীর জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ দুই হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এক হাজার ৯৭১ জন শিক্ষার্থী দুই হাজার টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। এছাড়া এক হাজার ৫০০ টাকার প্যাকেজে রেজিস্ট্রেশন করেছেন আরও ৩৩৮ জন শিক্ষার্থী। সাবেক শিক্ষার্থীদের স্বামী-সন্তান, আত্মীয়, ড্রাইভার মিলিয়ে আরও ৬৭২ জন রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন। এর মধ্যে আত্মীয় কিংবা স্বামীদের ক্ষেত্রে দুই হাজার, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এক হাজার ৫০০ এবং ড্রাইভারদের ফি ধরা হয়েছিল ৫০০ টাকা। সে হিসেবে কেবল রেজিস্ট্রেশন ফি থেকেই উঠেছে ৫৪ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা।
সকল ব্যয়ের হিসাব আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। আগামী দুই/তিনদিনের মধ্যে অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। সেখানে সব ব্যয়ের বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে। অডিট রিপোর্টের পর প্রতিবেদন প্রকাশের পরামর্শও দেন তিনি—তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব, সদস্য পুনর্মিলনী আয়োজক কমিটি
এছাড়া রিইউনিয়নে বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের দেওয়া অনুদান, সেনা কল্যাণ সংস্থা এবং একটি আইটি কোম্পানির স্পন্সর মিলিয়ে আরও ২৯ লাখ ৫৩ হাজার ৮০০ টাকা ওঠে। সব মিলিয়ে রিইউনিয়নে অর্থ আদায় হয় ৮৪ লাখ ২ হাজার ৩০০ টাকা। এই অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন পুনর্মিলনীতে অংশ নেওয়া সাবেক শিক্ষার্থীরা। রেজিস্ট্রেশন ফি ও স্পন্সরের কাছ থেকে আদায় করা অর্থের বড় একটি অংশ আয়োজক কমিটি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের।
তারা বলছেন, বাস ভাড়া, র্যালির ব্যয় ছাড়াও প্রায় সবক্ষেত্রেই অনিয়ম করা হয়েছে। অনুষ্ঠান রিহার্সালের ব্যয় দেখানো হয়েছে লাখ টাকা। নাচের প্রস্তুতি নিতে কেন টাকা ব্যয় করা হবে; সেটি তাদের বোধগম্য নয়। স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলেও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট-এর জন্য সাড়ে ১৯ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। স্টেজ, গেট এবং শিক্ষার্থীদের বসার জন্য যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেজন্য এত টাকা ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত। প্রায় এক হাজার টি-শার্ট স্পন্সর পাওয়ার পরও টি-শার্টের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮ লাখ টাকা। অথচ টি-শার্টের কোয়ালিটি নিম্নমানের ছিল বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের সকালের নাস্তা এবং দুপুরের খাবার নিয়েও অভিযোগ জানিয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা। তারা জানিয়েছেন, দুপুরের খাবর মেন্যুতে মোরগ পোলাও দেওয়া হলেও সবাই খাবার পাননি। খাবারের টোকেন নিয়ে গেলেও অনেককে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। এছাড়া সকালের নাস্তায় পানির বোতলের সংকট দেখা দিয়েছিল। যদিও চার হাজার বোতল পানি স্পন্সর করেছিল প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এক শিক্ষার্থী।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পুনর্মিলনীতে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানটির ২০১১-২০১৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, অনুষ্ঠানে অনেকেই তাদের ছোট বাচ্চাকে সঙ্গে এনেছিলেন। এই বাচ্চাগুলো রাত ১২টা পর্যন্ত না খেয়েছিল। যা একজন অভিভাবকের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। এছাড়া বাস ভাড়া করা হলেও রাতে বাসই পাওয়া যায়নি। গভীর রাতে নারীরা বাসায় যেতে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছেন। ডিজে এবং কমেডিয়ানের জন্য ৭৫ হাজার টাকা ব্যয় করা হলেও তারা অনুষ্ঠানে আসেননি। এত বড় একটা অনুষ্ঠানে এমন অনিয়ম মেনে নেওয়া যায় না।
নাজমুল হক সজীব নামে সাবেক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ আমাদের আবেগের জায়গা। ভালোবাসার জায়গা। এই আবেগ নিয়ে একটি মহল খেলছে। আমি দুই মেয়েকে নিয়ে পুনর্মিলনীর অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। একজন ক্লাস থ্রি এবং অন্যজন ক্লাস টুতে পড়ে। নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ব করে তাদের কত গল্প করেছি। অথচ এই অব্যবস্থাপনার কারণে মেয়েদের সামনে আমার প্রতিষ্ঠানের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ছোট্ট বাচ্চা দুটিকে রাত ১টা পর্যন্ত কিছু খাওয়াতে পারিনি। ঈদের পরের দিন রিইউনিয়ন হওয়ায় দোকান বন্ধ ছিল।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বলা হয়েছিল, যাতায়াতের জন্য বাসের ব্যবস্থা করা হবে। অথচ রাতে কোনো বাস দেওয়া হয়নি। রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত ঘুম-ঘুম ভাব নিয়ে আমার স্ত্রী ও মেয়েদেরকে রাস্তার এক পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে যানবাহন ম্যানেজ করতে হয়েছে। এত রাতে সিএনজি কিংবা রিক্সা কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিবারকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম।
এদিকে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় উৎসবে-৪৫ আয়োজক কমিটিকে প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি তুলেছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। তারা বলছেন, ২০১৪ সালের পুনর্মিলনীতেও একই ধরনের অনিয়ম হয়েছিল। তবে প্রথমবার এত বড় অনুষ্ঠান হওয়ায় সবাই সেটি মেনে নিয়েছিল। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হওয়ায় এই কমিটির অধীনে আর কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন চান না তারা।
তারা বলছেন, রিইউনিয়নের সম্পূর্ণ আয়োজক দলের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ আর্থিক হিসাব (বিল, চালান, রিসিপ্ট, ভাউচার ও অন্যান্য দলিল সহ) একটি উন্মুক্ত সভায় বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ উত্থাপন করতে হবে৷ আয়োজকদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, অব্যবস্থাপনা ও যাবতীয় অসামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়ে যথাযথ জবাবদিহি করতে হবে। একই সঙ্গে কারো বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আর্থিক ব্যয় ও অন্যান্য অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে আয়োজক কমিটির সদস্য তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব বলেন, সকল ব্যয়ের হিসাব আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। আগামী দুই/তিনদিনের মধ্যে অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। সেখানে সব ব্যয়ের বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে। অডিট রিপোর্টের পর প্রতিবেদন প্রকাশের পরামর্শও দেন তিনি।