কারও মৃত্যু, চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছেন কেউ— ঝুলে আছে ২৭ হাজার শিক্ষকের পেনশনের টাকা

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট লোগো
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট লোগো   © টিডিসি ফটো

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্রীরামপুর গ্রামে অবস্থিত এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছেন চাকরিজীবনে। ২০২০ সালের ২১ জুন অবসর গ্রহণ করেন শিক্ষক নজরুল। অবসরে যাওয়ার পর কল্যাণ তহবিলের ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পেলেও আজ পর্যন্ত পেনশনের একটি টাকাও পাননি এ শিক্ষক। এর মধ্যেই সম্প্রতি তার অসুস্থ স্ত্রী মারা গেছেন চিকিৎসার অভাবে। চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় নিজের প্রেয়সীর মৃত্যু দেখেছেন চোখের সামনে। 

এদিকে কুমিল্লা জেলার বরুড়ার শাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাঈম উদ্দিন আহমেদ ২০২১ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করার পর এখনও পাননি পেনশনের একটি টাকাও। বর্তমানে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত এ শিক্ষককে নিজের সমস্ত সম্পদ ও সঞ্চয় ভাঙতে হয়েছে ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার সামলাতে। অবসরে যাওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও, নাঈম উদ্দিনের কপালে এখনও জোটেনি একটি টাকাও।

এ অবস্থা কেবল শিক্ষক নজরুল ইসলাম এবং নাঈম উদ্দিনের নয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষালয়ের প্রায় ২৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষকের অবসর পরবর্তী সময়ের নিদারুণ আর যাপিত বাস্তবতার করুন গল্পও। এর মধ্যে মারাও গেছেন কেউ কেউ, আর চিকিৎসার অভাবে ধুঁকছেন বার্ধক্যে উপনীত এ আলোকবর্তিকারা। মানুষ গড়ার এসব কারিগরদের কেবলই ছোট্ট একটি চাওয়া—অবসর পরবর্তী সকল সুবিধা এবং পেনশনের কয়েকটা টাকা। 

বাংলাদেশে বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজারের মতো। এর মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা। দেশের বেসরকারি এসব শিক্ষালয়ে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অবসরে গেলে অবসর বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে আর্থিক সুবিধা পান সরকারি নিয়ম অনুযায়ী। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির তহবিল ঘাটতি (ফান্ড সংকট), পর্যাপ্ত জনবল না থাকা এবং নিজস্ব কোনো অফিস না থাকায় শিক্ষকদের দ্রুততর সময়ে সেবা দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠার তিন দশক পার হলেও এখনও নিজস্ব কোনো অফিস করার সুযোগ পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। নানা সংকটে থাকলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ শিক্ষককে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট বলছে, বর্তমানে তাদের কাছে কল্যাণ তহবিল থেকে ভাতার জন্য আবেদন করেছেন প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষক। তাদের ভাতা প্রদানের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা নেই প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব তহবিলে। এছাড়াও দ্রুততম সময়ে এসব শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সেবা প্রদানের জন্য ৬০ এর বেশি জনবল প্রয়োজন হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মিত এবং অনিয়মিত মিলিয়ে জনবল রয়েছে মাত্র ১৭ জন। আর ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনও নিজস্ব কোনো ভবন বা অফিস কাঠামো দাঁড় করাতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে প্রতি মাসে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টে টাকা আসে ৫২ থেকে ৫৩ কোটির মতো। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির মাসে আর্থিক চাহিদা ৬০ থেকে ৬৪ কোটির মতো। ফলে বছরান্তে প্রতিষ্ঠানটির ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২০ কোটি টাকার মতো। অবশ্য ঘাটতি পূরণে সরকারের কাছে বিশেষ ফান্ডের দাবিও রয়েছে ট্রাস্টের। এর আগে বিগত ২০১৬ সালে ৫০ কোটি, ২০১৭ সালে ৫০ কোটি এবং ২০১৮ সালে ২৩৫ কোটি ও ২০১৯ সালে ২৫ কোটি টাকাসহ এখন পর্যন্ত ৩৬০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছে এ ট্রাস্ট।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের চলমান এ আর্থিক সংকটের মূল কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, শিক্ষকদের বেতন স্কেল পরিবর্তনের ফলে এ সংকট হয়েছে। ট্রাস্টের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, প্রার্থীর সর্বশেষ বেতন স্কেলে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের কল্যাণ সুবিধা প্রদানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৬২ শতাংশ এবং ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেলে ১০০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির ফলে কল্যাণ ট্রাস্টে আর্থিক সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

আরও পড়ুন: ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীকে অবসর সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ হাইকোর্টের

এর বাইরে ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে ২০০ কোটি টাকা ফান্ডে জমা না হওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়ে এ ট্রাস্ট। ট্রাস্টের আইন অনুযায়ী এমপিওভুক্ত প্রত্যেক শিক্ষক কর্মচারীর মূল বেতন থেকে প্রতি মাসে ৪ শতাংশ কল্যাণ সুবিধা বাবদ কর্তন করা হয়। যা ২০১৮ সালের পূর্বে ছিল ২ শতাংশের সমপরিমাণ। এছাড়া শুরুতে বিধান থাকলেও ২০০২ সালে আইন সংশোধনের ফলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বার্ষিক ৫ টাকা হারে চাঁদা আদায় বন্ধ হওয়ায় বিগত ২১ বছরে প্রায় ২৫০ কোটির মতো অর্থ জমা পড়েনি ট্রাস্ট্রের ফান্ডে।

আর এসব সংকট উত্তরণের উপায় খুঁজছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টও। তবে এক্ষেত্রে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের অনেকটা নির্ভর করতে চায় তারা। এর মধ্যে—নিজস্ব একটি অফিস ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা সৃষ্টি, এককালীন ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার আর্থিক তহবিল, জনবল বৃদ্ধি, অনলাইন সেবা, কল সেন্টার চালু, হেল্প ডেস্ক স্থাপনসহ নানা কর্মসূচি রয়েছে।

সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কথা হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজুর সাথে। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করার জন্য। এছাড়াও জনবল বৃদ্ধি এবং নিজস্ব ভবনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি। শুরু থেকেই বর্তমান সরকারের শিক্ষকদের নিয়ে উদারতা রয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই চলমান সংকটের সমাধান হবে।

অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, এখন আমাদের কাছে ২৭ হাজার শিক্ষকের আবেদন জমা রয়েছে। তাদের এসব আবেদন নিষ্পত্তি করার মতো অর্থ এখন আমাদের তহবিলে নেই। সেজন্য আমরা সরকারের কাছে এককালীন বরাদ্দ চেয়েছি। অর্থ পেলেই আমরা এসব আবেদনের অর্থ শিক্ষকদের হাতে তুলে দিতে পারব।

প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিগত ১৮ বছরে কল্যাণ সুবিধা বাবদ প্রদত্ত টাকার পরিমাণ ২৭৯ কোটি টাকা এবং ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষক কর্মচারীকে কল্যাণ সুবিধা বাবদ ৩ হাজার ২ শত ৮৮ কোটি টাকা প্রদান করা হয়।


সর্বশেষ সংবাদ