শিক্ষার্থীদের স্কুলে ব্যয় বাড়ছেই, নীতিমালা না থাকাকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা
দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। কেউ কেউ শিক্ষার এই ব্যাপক সংস্কারকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও অনেক অভিভাবক এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে পাঠ্যসূচির পরিবর্তন ও পরিমার্জন শুধু সমস্যার কারণ নয়, অভিভাবকদের কাছে বর্তমানে অন্যতম মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের সন্তানদের পড়ালেখার খরচ। একজন শিশুকে স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে তার বই-খাতা, পোশাক, মাসিক ও পরীক্ষার ফি, যাতায়াত ও আনুষঙ্গিক ফির জন্য একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মাসিক আয়ের একটি বড় অঙ্কের অর্থ গুণতে হয়।
বর্তমানে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে শিক্ষা উপকরণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফিসহ অন্যান্য খরচ। এতে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের ঝড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের তদারকির অভাব, টেকসই পদক্ষেপের ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর উদাসীনতা, দরিদ্র শিক্ষার্থী ভাতা না পাওয়া এবং সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা হারানোকে দায়ী করছেন তারা।
গত বছরের শুরুতে প্রকাশিত ইউনেস্কো গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করে শিক্ষার্থীদের পরিবার। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ পাকিস্তানেও এ হার কম; প্রায় ৫৭ শতাংশ। এই ৭১ শতাংশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় আবার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারির তুলনায় তিনগুণ শিক্ষা ব্যয় বহন করতে হয় অভিভাবকদের। যা বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে এ ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় নয়গুণ।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুন্দর অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও অভিভাবকরা বাচ্চাদের কিন্ডারগার্টেনে দেন। যেখানে দেওয়ার কোনো মানে থাকে না— সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি
ইউনেস্কোর ওই গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল। আবার মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯৪ শতাংশই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠ নিয়ে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবার ঋণ করে বেসরকারি পলিটেকনিকে পড়াশোনার খরচ মেটায়।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ৮০ শতাংশের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরচ বাংলাদেশে, যা প্রায় ৫৫ শতাংশ। এছাড়া প্রাথমিকে সর্বোচ্চ ভারতে ৪৫ শতাংশ, বাংলাদেশে ২৪ শতাংশ এবং উচ্চ শিক্ষায় সর্বোচ্চ ভারতে ৫৭ শতাংশ আর বাংলাদেশে এ হার ৩৬ শতাংশ। গড়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেসরকারি খাতে নির্ভরতা বেশি।
আরও পড়ুন: সরকারি চাকরিতে বিষয় কোড না থাকা বিভাগের জন্য সুখবর ইউজিসির
দেশে কোটিপতি, ধনী এবং অতিধনীদের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে যাওয়ায় ইংরেজি মাধ্যমে ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা এবং সেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তিতে আগ্রহ বাড়ছে অভিভাবকদেরও। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার্থীদের সাথে তাল মেলাতে অর্থের অভাব থাকলেও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদেরও এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান অভিভাবকরা। তবে অনেক অভিভাবক ইংরেজি মাধ্যমে নিজের সন্তানকে না দিতে পারলেও অন্তত বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান।
দেশের ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো নীতিমালা ও নজরদারি না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ভর্তি ও টিউশন ফি হিসেবে মাত্রাতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিভাবকদের বেশি আপত্তি রয়েছে, বছরান্তে নতুন করে ভর্তি ফি নিয়ে। তাদের মতে, একজন শিক্ষার্থী একটি প্রতিষ্ঠানে একবার ভর্তি হওয়ার পর বছর শেষে বা নতুন শ্রেণিতে ফের ভর্তি হওয়া এবং অতিরিক্ত ফি নেওয়া অযৌক্তিক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব ফির হার ইংরেজি মাধ্যমের তুলনায় অনেক কম হলেও একটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে তার ভার অনেক।
আমাদের উদ্দেশ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী পাঠানো না বরং আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বিনামূল্যে অথবা যতটা সম্ভব কম মূল্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। সরকারি স্কুলগুলোকে এমন রূপ দেওয়া যাতে অভিভাবকরা এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের পাঠাতে আগ্রহী হয়। সেই সঙ্গে করতে হবে নীতিমালা প্রণয়নও। এমনটি হলে বেসরকারি স্কুলগুলোও তাদের মান বাড়ানোর চেষ্টা করবে— মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন, সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জবি
এ সমস্যার কথা স্বীকার করে এর কারণ হিসেবে অভিভাবকদের দায়ী করেছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছিলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুন্দর অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও অভিভাবকরা বাচ্চাদের কিন্ডারগার্টেনে দেন। যেখানে দেওয়ার কোনো মানে থাকে না। শিক্ষার্থীদের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তাকে গড়ে তুলতেই নতুন শিক্ষাক্রম হাতে নেয়ার কথাও জানিয়েছিলেন মন্ত্রী। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষক প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের সকল শিক্ষকদের সারাবছর প্রশিক্ষণের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
তবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় নিরসনে ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি এখন পর্যন্ত। একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সন্তানদের ভর্তির সময় ফি ও শিক্ষাসামগ্রী মিলিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি টাকা খরচ হয়েছে। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ফি তেমন নেই তবে শিক্ষাসামগ্রীর দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মাসে সন্তানদের পেছনে তাদের মাসিক আয়ের একটা বড় অংশ ব্যয় করতে হয়।
দেশের শিক্ষাসামগ্রী বিক্রির দামের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বই, খাতা, কলম, পেনসিল, রংপেনসিল, জ্যামিতি বক্স, কলম বক্স, স্কেল, রাবার, ক্লিপবোর্ড, ফাইলসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। মানভেদে প্রতিটি খাতার দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা। কলমের দাম বেড়েছে প্রতি ডজনে (১২ পিস) ১৫ থেকে ৪০ টাকা। প্রতি ডজন পেনসিলের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা। কিছুটা মোটা সাইজের একটি খাতার দাম ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পোশাক, জুতা ও স্কুল ব্যাগের দামও। আর এই দামে সন্তানদের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা।
অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার মান ও অধিকার নিশ্চিতে সরকারের টেকসই কোনো পদক্ষেপ নেই। নিয়ন্ত্রণ নেই শিক্ষাসামগ্রী বিক্রির বাজারেও। এছাড়া অনেকেই শিক্ষক হিসেবে প্রান্তিক অঞ্চলে যেতে চান না বিধায় এসব এলাকায় ভালো শিক্ষক থাকে না। ফলে বাধ্য হয়ে শহরমুখী হয় অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার। আর তাই শিক্ষার ব্যয়ও বাড়ে।
আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ক্যাডারভিত্তিক বিষয়ে মন নেই
তবে শিক্ষার্থীদের সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগ্রহী করতে এবং নতুন শিক্ষাক্রম অভিভাবকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। কিন্তু শুধু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হয় এমন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন এ সংকট সমাধানে পুরোপুরি কার্যকর হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, শিক্ষার ব্যয় কমাতে একজন অভিভাবকের চাকরির বেতন কেমন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, যানবাহন খরচ, সরকারি পরিসেবাসহ বিভিন্ন বিষয়ও জড়িত। তাই এ জন্য সরকারকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে সকল মন্ত্রাণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় হয়। তা না হলে আগামী দিনে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিতদের সংখ্যা আরও বাড়বে।
গত বছরের শুরুতে প্রকাশিত ইউনেস্কো গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করে শিক্ষার্থীদের পরিবার। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ পাকিস্তানেও এ হার কম; প্রায় ৫৭ শতাংশ— ইউনেস্কো গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা কিছুটা সরকারি প্রতিষ্ঠান নির্ভর হলেও মাধ্যমিক শিক্ষা পুরোপুরি বেসরকারি নির্ভর হয়ে গেছে। বিশেষ করে শহর অঞ্চলে এই প্রবণতা বেশি থাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো সার্ভিস দিচ্ছে না এবং সেগুলো মানসম্মতও না। তাই বাধ্য হয়ে কষ্ট হলেও অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাচ্ছেন।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এ শিক্ষক আরও বলেন, কোনো শিক্ষার্থী সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়বে তা পছন্দের অধিকার শুধুমাত্র তার অভভাবকের। যেহেতু শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার তাই তার পছন্দের অধিকারও থাকতে হবে। সরকার যেটা করতে পারে তা হলো সরকারি স্কুলগুলোকে এমন রূপ দেওয়া যাতে অভিভাবকরা এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের পাঠাতে আগ্রহী হয়।
এমনটি হলে বেসরকারি স্কুলগুলোও তাদের মান বাড়ানোর চেষ্টা করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম বা বেসরকারি স্কুলে পড়াতে চান। কিন্তু একটা পর্যায়ে জ্যামিতিক হারে ফি বাড়তে থাকলে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। তখন তারা চাইলেও আর মেইনস্ট্রিম কারিকুলামে ফিরতে পারেনা। ফলে ঝড়ে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী।
বিশ্বের অনেক দেশে মাধ্যমিক পর্যন্ত ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষা একটি অধিকার তাই ন্যায্যমূল্য এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে একটি নীতিমালা করা উচিত যা সরকার এখন পর্যন্ত করতে পারেনি। তবে আমাদের উদ্দেশ্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী পাঠানো না বরং আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ন্যায্যমূল্যে অথবা বিনামূল্যে অথবা যতটা সম্ভব কম মূল্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা।
এ সংকটের অন্যতম কারণ দারিদ্রতা এবং শিক্ষা ফি‘র কোনো নীতিমালা না থাকাকে দায়ী করে সংকট মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে এই শিক্ষা বিশ্লেষক আরও বলেন, ফি-নিয়োগসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরিচালনায় শিক্ষানীতি প্রণয়ন জরুরি। সেই সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন শিক্ষা বৃত্তি দরিদ্র বা প্রান্তিক অঞ্চলেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীরা পাচ্ছে কিনা তার পূর্ণ তদারকি করা প্রয়োজন। এছাড়া মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্বিক তত্ত্বাবধানের আওতায় আনার পরামর্শ এই শিক্ষাবিদের।