০৯ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৪৮

দ্রুত বই ছাপাতে মানে ‘আপস’ এনসিটিবির

এনসিটিবির লোগো ও ছাপাখানা  © টিডিসি ফটো

নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে দুই মাসেরও কম সময় বাকি। অষ্টম শ্রেণির অধিকাংশ বই ছাপানোর কাজ বাকি রয়েছে। নবম শ্রেণির বই ছাপানোর কাজ শুরুই হয়নি। এছাড়া ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইও ছাপানো হয়নি। এই অবস্থায় দ্রুত বই ছাপার কাজ শেষ করতে মানের সঙ্গে ‘আপস’ করতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। 

এনসিটিবি, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ও বই ছাপার সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তুলতে ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিন বিনা মূল্যে ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই তুলে দিচ্ছে সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রায় ৩১ কোটি বই ছাপানোর কাজ চলছে। এবার অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই ও টিচিং গাইড (টিজি) দেওয়া হচ্ছে।

হরতাল-অবরোধের কারণে কাগজের সংকট দেখিয়ে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানো হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি ছাপাখানা নিম্ন মানের কাগজে বই ছাপার পাঁয়তারা করছেন। দ্রুত বই ছাপার কাজ শেষ করতে গিয়ে এনসিটিবি তাদের সেই পাতানো ফাঁদেই পা দেবে বলে মনে করছেন তারা। কেননা মাধ্যমিক পর্যায়ের ১০ কোটির বেশি বই ছাপানোর কাজ শুরুই হয়নি। এই অবস্থায় মানের সাথে আপোষ করে বই ছাপানোয় বেশি মনোযোগ দেবে এনসিটিবি বলে দাবি তাদের।

এনসিটিবির উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ২০২৩ সালের নতুন বই দেওয়া নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। বিশেষ করে প্রাথমিকের বই অনেক দেরিতে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। সেজন্য এবার ‘যেভাবেই’ হোক দ্রুত সময়ের মধ্যে বই ছাপার কাজ শেষ করতে চায় এনসিটিবি। এক্ষেত্রে বইয়ের মানের সাথে ‘কিছুটা ছাড়’ দেওয়া হতে পারে।

যদিও এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বইয়ের মান নিয়ে আপসের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আগামী ১ জানুয়ারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই উৎসব হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বই ছাপার কাজ শেষ হবে। বইয়ের মান নিয়ে কোনো আপস করা হচ্ছে না।’

বই বাধাই করার পর সাজিয়ে রাখা হয়েছে

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হরতাল-অবরোধের কারণে কাগজের সংকট দেখিয়ে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানো হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি ছাপাখানা নিম্ন মানের কাগজে বই ছাপার পাঁয়তারা করছেন। দ্রুত বই ছাপার কাজ শেষ করতে গিয়ে এনসিটিবি তাদের সেই পাতানো ফাঁদেই পা দেবে বলে মনে করছেন তারা। কেননা মাধ্যমিক পর্যায়ের ১০ কোটির বেশি বই ছাপানোর কাজ শুরুই হয়নি। এই অবস্থায় মানের সাথে আপস করে বই ছাপানোয় বেশি মনোযোগ দেবে এনসিটিবি বলে দাবি তাদের।

সরেজমিনে রাজধানীর প্রেসপট্টি হিসেবে খ্যাত মাতুয়াইলে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রেসে সপ্তম শ্রেণির বই মুদ্রণের কাজ চলছে। ছাপাখানায় দরপত্রে উল্লেখিত কাগজের উজ্জ্বলতার শর্ত অনুযায়ী পাঠ্যবই ছাপাচ্ছে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। তবে কয়েকটি ছাপাখানায় নিম্ন মানের (নিউজপ্রিন্ট) কাগজে বই ছাপানো হচ্ছে। বই প্রিন্টের পর এর উজ্জ্বলতা আরও কমে যাচ্ছে। এসব তদারক করার জন্য এনসিটিবির কোনো ইন্সপেকশন অফিসারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

নিয়ম অনুযায়ী বই ছাপার কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে এনসিটিবির ইন্সপেকশন অফিসারদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার কথা। তবে তারা প্রেসগুলোতে অনিয়মিত। বুধবার বিকেলে মাতুয়াইলের ৬টি প্রেসে গিয়ে এনসিটিবির একজন ইন্সপেকশন অফিসারকেও পাওয়া যায়নি। 

‘এবার আমরা কাগজের মান নিয়ে কোনো আপোষ করবো না। নিম্ন মানের কাগজে বই ছাপানোর কারণে আমরা কয়েক হাজার ফর্মা বাতিল করে দিয়েছি।’— অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম, চেয়ারম্যান এনসিটিবি

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাতুয়াইলে অবস্থিত একটি প্রেসের ম্যানেজার দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘২০২৩ সালের পাঠ্যবই দেরিতে দেওয়ার কারণে এবার দ্রুত সময়ের মধ্যে বই পৌঁছানোর তাগাদা দেওয়া হয়েছে। যেভাবেই হোক বেধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে বই ছাপানোর কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কেউ কেউ নিউজপ্রিন্টের কাগজে বই ছাপাচ্ছেন।’

এনসিটিবির ইন্সপেকশন অফিসার আসে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সপ্তম শ্রেণির বই ছাপানোর দায়িত্ব পাওয়া ওই প্রেসের ম্যানেজার জানান, ‘ইন্সপেকশন অফিসাররা আসেন। তবে তারা বেশি সময় অবস্থান করেন না। এছাড়া ইন্সপেকশন অফিসার আসার খবর পেলে নিম্নমানের উপকরণ সরিয়ে নেওয়া হয়।’

নতুন বই হাতে শিক্ষার্থীরা

জানা গেছে, এবার নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই বিতরণ করা হবে। নবম শ্রেণির জন্য ৫ কোটির বেশি বই ছাপানো হবে। নবম শ্রেণির বইয়ের পারসেজ অর্ডারসহ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন মিলেছে গত মঙ্গলবার। প্রেসগুলো এখনো কাজের অর্ডার পায়নি। এই অবস্থায় এই শ্রেণির বই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।

এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘নবম শ্রেণির বই ছাপানোর জন্য ৫০ দিনের সময় বেধে দেওয়া হয়েছে। ফলে এই বই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ছাপানোর কাজ শেষ করা কঠিন। মুদ্রণকারীদের দ্রুত বই ছাপার কাজ শেষ করতে বলায় বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।’

কোনো প্রেস নিম্ন মানের কাগজে বই ছাপালে তাদের ফর্মা বাতিল করা হচ্ছে জানিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এবার আমরা কাগজের মান নিয়ে কোনো আপোষ করবো না। নিম্ন মানের কাগজে বই ছাপানোর কারণে আমরা কয়েক হাজার ফর্মা বাতিল করে দিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি আমাদের ইন্সপেকশন অফিসারদের ফাঁকি দিয়ে নিম্ন মানের কাগজে বই ছাপায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন বই পাওয়ার পর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অভিযোগ করলে সংশ্লিষ্ট ছাপাখানার বিল কর্তন করা হবে বলেও জানান তিনি।’