১৯ মে ২০২৫, ১৬:৫৫

রান্নার মসলা থেকে ওষুধি গুণে ভরপুর একটি উপাদান লবঙ্গ

লবঙ্গ  © সংগৃহীত

লবঙ্গ আমাদের খুব পরিচিত একটি মসলা, যা রান্নায় ব্যবহারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে এটি ঝাল ও মিষ্টিজাত খাবারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রাচীন সিরিয়া, চীন, রোম ও আফ্রিকাতে লবঙ্গের অস্তিত্ব ছিল। আধুনিক সময়ে এটি প্রথম পাওয়া যায় ইন্দোনেশিয়ার মালুকু দ্বীপপুঞ্জে, যেখান থেকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে এটি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

চিরসবুজ লবঙ্গগাছের ফুলের কুঁড়িই শুকিয়ে লবঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Syzygium aromaticum। লবঙ্গের মধ্যে থাকা ইউজেনল নামের একটি শক্তিশালী যৌগ এর বিশেষ সুগন্ধ ও ওষুধি গুণের জন্য দায়ী। এই উপাদানটি জীবাণু ও ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও এতে রয়েছে ক্যারিওফিলিন নামক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান।

পুষ্টিগুণের দিক থেকেও লবঙ্গ সমৃদ্ধ। এক চামচ গুঁড়া লবঙ্গে থাকে ৬ ক্যালরি, ১ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১ গ্রাম ফাইবার, দৈনন্দিন চাহিদার ৩ শতাংশ ভিটামিন সি, ২ শতাংশ ভিটামিন কে এবং ৫৫ শতাংশ ম্যাঙ্গানিজ। এতে আরও রয়েছে সামান্য ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন ই এবং ক্যারোটিন, যা শরীরে ভিটামিন এ হিসেবে কাজ করে।

প্রাচীন চীনের হান রাজবংশে রাজসভার সদস্যদের মুখে লবঙ্গ রেখে প্রবেশ করতে হতো, যাতে মুখের দুর্গন্ধ না থাকে। আমাদের উপমহাদেশে এখনও দাঁতের ব্যথা হলে লবঙ্গ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, দাঁতের সমস্যা যেমন দুর্বল মাড়ি, দুর্গন্ধ ও প্ল্যাক কমাতে লবঙ্গ, টি ট্রি অয়েল ও তুলসীযুক্ত ভেষজ মাউথওয়াশ বেশ কার্যকর।

লবঙ্গ খাদ্যে বিষক্রিয়া সারাতেও সহায়ক। এতে থাকা ইউজেনল ব্যাকটেরিয়াজনিত বিষক্রিয়া দমন করে, বিশেষ করে E. coli, Streptococcus ও Staphylococcus ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও লবঙ্গ কার্যকর। এতে থাকা নাইজেরিসিন নামের যৌগ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমায় এবং রক্ত থেকে শর্করা কোষে পৌঁছাতে সাহায্য করে।

লবঙ্গ অ্যান্টি-অক্সিডেন্টেরও ভালো উৎস। ইউজেনল ভিটামিন ই-এর চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি কার্যকরভাবে শরীরে ফ্রি র‍্যাডিকেলের ক্ষতি রোধ করে, যা ক্যানসারের অন্যতম কারণ। হাড়ের স্বাস্থ্যের দিক থেকেও লবঙ্গ উপকারী। এতে থাকা ইউজেনল হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে এবং ম্যাঙ্গানিজ হাড়কে করে মজবুত। পাকস্থলীর আলসার নিরাময়েও এটি উপকারী। লবঙ্গ থেকে তৈরি অ্যাসেনশিয়াল অয়েল পাকস্থলীতে সুরক্ষাকারী মিউকাস উৎপন্ন করে, যা আলসারের ঝুঁকি কমায়।

লবঙ্গ খাওয়ার উপায়ও সহজ। এটি মসলা হিসেবে রান্নায় ব্যবহার করা যায়। চাইলে লবঙ্গ চা তৈরি করে খাওয়া যায়—৫-৬টি লবঙ্গ এক কাপ পানিতে জ্বাল দিলেই তৈরি হয় লবঙ্গ চা, যা সর্দি-কাশিতেও উপকারী। আবার সামান্য লবণ দিয়ে চিবিয়ে খাওয়া যেতে পারে, তবে যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাঁদের জন্য এটি না খাওয়াই ভালো।

তবে লবঙ্গের ব্যবহার নিয়ে কিছু সতর্কতা আছে। এতে থাকা ইউজেনল উপকারী হলেও অতিরিক্ত খেলে এটি যকৃতের ক্ষতি করতে পারে। তাই পরিমিত মাত্রায় খাওয়াই নিরাপদ। বিশেষ করে ১৫ বছরের নিচের শিশুদের জন্য লবঙ্গ বা লবঙ্গ চা এড়িয়ে চলাই ভালো। রান্নার পাশাপাশি স্বাস্থ্য রক্ষায়ও যদি লবঙ্গকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগানো যায়, তাহলে এটি হতে পারে এক প্রাকৃতিক পথ্য।