৩০ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:২৬

স্মৃতির পাতায় স্বপ্নের প্রথম ট্যুর

  © টিডিসি ফটো

একদিন ক্লাসে দাঁড়িয়ে ফায়সাল স্যারকে বললো, ‘আমরা অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি অথচ এখন পর্যন্ত আমাদের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে কোনো ক্লাস পার্টি বা ট্যুর হয়নি। এই তিন বছরে অনেকে উদ্যোগ নিলেও বিভিন্ন কারণে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। আপনাদের দিকনির্দেশনা পেলে আমরা অবশ্যই সফলভাবে এই ধরনের একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারবো।’

এখান থেকেই শুরু আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুর আয়োজন এবং তা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য। শিক্ষকরা আমাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের সহযোগিতা করার আশ্বাস ও দিলেন। আমাদের আযম খান কমার্স কলেজে নিজেদের উদ্যোগে এবং সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে এ ধরনের ট্যুরের খুব একটা উদাহরণ নেই।

সেইদিনই স্যার চলে যাওয়ার পরে আমি, ফায়সাল, ফাইজা, শ্রাবনী, রাফিদ, হাসিবসহ আরো কিছু বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম যে, মোংলা পোর্ট এবং ইপিজেড হয়ে করমজল থেকে ঘুরে আসবো। অক্টোবরের ২৩ তারিখকে ট্যুরে যাবার জন্য আমরা বেছে নিলাম। তখনই আমরা ট্যুরের একটি খসড়া পরিকল্পনা ও বাজেট করে ফেলি।

ডিপার্টমেন্টে আমাদের ব্যাচের সকল শিক্ষার্থীকে জানানো এবং অনুমতি যোগাড় করাটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কাজটি দক্ষতার সাথে করে ফায়সাল ও ফাইজা। ফেসবুকের কল্যাণে যোগাযোগের কাজটি সহজে হলেও অফিসিয়াল অনুমতি পেতে একটু বেগই পোহাতে হয় আমাদের। আমাদের ট্যুরের পরিকল্পনা শুনে সহপাঠীরা সবাই উদ্যোগটিকে স্বাগত জানায়।

সত্যি বলতে নিজেদের ভিতর গাঢ় ঐক্য থাকলে সহজেই শত প্রতিকূলতাকে জয় করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানো সম্ভব। মূলত সবার সহযোগিতাই আমাদের এই ট্যুর আয়োজন এবং বাস্তবায়নের কাজ অনেকাংশেই সহজ করে দিয়েছিল। সবদিক বিবেচনা করে আমরা ট্যুরের চাঁদা নির্ধারণ করলাম ৫৫০ টাকা।

এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা প্রথমে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে ট্যুরে যাওয়ার পারমিশন নিই। অন্যদিকে ফাইজা মোংলা বন্দর ও ইপিজেড পরিদর্শন করার পারমিশন নিলে আমাদের কাজের প্রতি উৎসাহ আরো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। কোন বাসে যাবো তা ঠিক করা হলো। এক্ষেত্রে শ্রাবনীর বাবার নিজের বাস থাকায় আমরা একটা বড় অংকের ডিসকাউন্ট পাই।

এদিকে ফায়সাল ও হাসিব মোংলা গিয়ে আমাদের দুপুরের খাবারের একটা চমৎকার ব্যাবস্থা করে এবং ঘাটে গিয়ে একটি বড় ট্রলার ঠিক করে করমজল যাওয়ার জন্য। বড় কাজগুলো সম্পন্ন করে ফেলার পর আমরা নজর দিই ছোট টুকিটাকি কাজের দিকে। মোটকথা যাওয়ার আগের দিনই আমরা যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলি।

অবশেষে আসে আমাদের সেই প্রতীক্ষিত দিনটি। তার আগের রাতে হয়তো কারোরই ভালো করে ঘুম হয়নি। কেননা এ ট্যুরকে ঘিরে আমরা সবাই ছিলাম দারুণ এক্সাইটেড। যাইহোক, পূর্ব নির্ধারিত সময় সকাল সাড়ে ৭টায় আমরা সবাই কলেজে এসে একত্রিত হই। কিন্ত তার একটু পরই পাওয়া আমাদের বন্ধু ফায়সালের চাচার মৃত্যুর সংবাদ আমাদের শোকাহত করে তোলে।

ফায়সাল খুবই ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতিটি সামাল দেয়। যেহেতু সে নিজের হাতে পুরো আয়োজনটি সম্পন্ন করেছে তাই তাকে ছাড়া কাজটি অনেকটাই দূরুহ ছিল। সে আমাদের ৪-৫ জনকে বিষয়টি জানায় এবং ফাইজাকে কাজগুলো বুঝায়। তার হাতে সব দায়িত্ব গুলো দিয়ে যায়। ফায়সালের চাচার মৃত্যু সংবাদটি পেয়ে আমরা মানসিকভাবে একদমই ভেঙে পড়েছিলাম।

আর ফায়সাল অনেক পরিশ্রম করেছিলো এই ট্যুরটি বাস্তবায়নে। তাই আমরাও ঠিক করলাম বন্ধুর জন্য হলেও আমরা আমাদের লক্ষ্য পুরন করবো। ঠিক আটটায় কলেজ গেট থেকে আমাদের বাস ছাড়ে। আমাদের সাথে কলেজের শ্রদ্ধেয় তিন স্যার ছিলেন। যারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ সময় আমাদের দিয়েছেন যাতে আমরা সুস্থ ও নিরাপদ ভাবে আমাদের ট্যুর শেষ করতে পারি।

১০টার দিকে বাসটি মোংলা ইপিজেডে পৌছালে সেখানে কর্মকতারা আমাদের গেট থেকে রিসিভ করেন এবং তাদের ব্যাগ প্রস্তুত করার কারখানায় নিয়ে যান। সেখানে আমাদের সবাইকে এই কারখানা কিভাবে পরিচালিত হয় এবং তাদের পণ্য প্রস্তুত ও সরবরাহ করার প্রক্রিয়াসহ যাবতীয় কার্যক্রমগুলো দেখানো হয়।

ইপিজেড ঘুরে আমরা মোংলা বন্দর পরিদর্শন করতে যাই। সেখানে আমাদের কিভাবে দেশের বাইরে থেকে পণ্য আমদানি রপ্তানি করা হয় তা বিস্তারিতভাবে দেখানো ও বুঝানো হয়। আমরা মোংলা বন্দর পরিদর্শন শেষে সবাই মিলে বেশ কিছু ছবি তুললাম এবং তারপর আমাদের বাসে করে ঘাটে গেলাম।

তখন দুপুর ১টা আমাদের খাবার হোটেল আগেই ঠিক করা ছিলো সেখানে সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেলাম। খাওয়া শেষ করে ঘাট থেকে ট্রলার নিয়ে করমজলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগলো। করমজল পৌঁছানোর পর আমরা আশেপাশের জায়গাটি ভালো করে ঘুরে দেখলাম।

এখানকার হরেক রকমের গাছ-পালা, জীব- বৈচিত্র্য, নদী সহ আশেপাশের মনোমুগ্ধকর। পরিবেশ যে কাউকেই আকৃষ্ট করতে বাধ্য। অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলে আমরা অনেকেই একসাথে বসে নাচগানে মেতে উঠি। তারপর বৃষ্টি শেষ হলে সবাই ট্রলারে করে আবার ঘাটে ফিরে আসি। বাস আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল। সবাই বাসে উঠে পড়ি।

এরপর মজা করতে করতে আমরা খুলনাতে ফিরে আসি। সেখান থেকে আমাদের শিক্ষাজীবনের সুন্দর কিছু মুহুর্ত নিয়ে আমরা যার যার বাসায় ফিরলাম।

লেখক: শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, সরকারী আযম খান কমার্স কলেজ, খুলনা