নিম্নমুখী ফল নিয়ে যা বললেন শিক্ষবিদরা
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব, শহর-মফস্বলে বৈষম্য, ঘনঘন পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন, ভালো শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা প্রভৃতি কারণে এবারের এইচএসসি ও সমমানের ফল নিম্নমুখী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, শিক্ষকরা এ পেশায় আসলে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। এজন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিতরা এ পেশায় আসতে কম আগ্রহী। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব শিক্ষক রয়েছেন তারা অতটা দক্ষ না, আর যারা দক্ষ তারা শহরমুখী।
তবে শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, যথাযথ মান বজায় রেখে পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করায় এবার পাসের হার কিছুটা কম হয়েছে।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গেল বছরের তুলনায় এবার পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমেছে। ১০টি শিক্ষা বোর্ডে এবার গড় পাসের হার ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ২৬২ জন।
ইংরেজি ও আইসিটিতে ফলাফল তুলনামূলক খারাপ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে ইংরেজিতে। এছাড়া মানবিকেও পাসের হার কমেছে। এ জন্য এর প্রভাব সার্বিক ফলাফলে পড়েছে। ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিলেট বোর্ড বাদে অন্য বোর্ডগুলোতে ইংরেজিতে পাসের হার ৬৫ থেকে ৭০ এর মতো। দিনাজপুর বোর্ডে ইংরেজি বিষয়ে ফেল করেছে ৩৯ হাজার ৫০০ জন। আর যশোর বোর্ডে ৬০ দশমিক ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী পাস করেছে। ফেল করা প্রায় ৪০ ভাগ শিক্ষার্থীই ইংরেজিতে খারাপ করেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরী বলেন, আমাদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। বেশিরভাগ কলেজে শিক্ষক নেই, যেখানে আছে তারা দক্ষ না। মফস্বলে সেটার অবস্থা বেশি খারাপ। দক্ষ শিক্ষক থাকলেও তারা মফস্বলে যেতে চায় না। সবাই শহরমুখী হয়ে যায়। মফস্বলে গেলেও লবিং-তদবির করে শহরে চলে আসে।
তিনি বলেন, আমি এখন সিলেটে রয়েছি। এখনাকার সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে ৯ বিষয়ে কোনো শিক্ষক নেই। তাহলে আমরা এসব কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কীভাবে ভালো ফল আশা করতে পারি?
ইংরেজি ও আইসিটির অবস্থা বেশি খারাপ উল্লেখ করে রাশেদা কে. চৌধূরী বলেন, সম্প্রতি পিএসসি থেকে ২৫০ জন আইসিটিতে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ১০০ জনও আবেদন করেনি। আমার প্রশ্ন হলো, আইসিটিতে যারা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত তারা কি কলেজের এই বেতনে কাজ করবে? এ জন্য আমরা আগে থেকে একটি দাবি করে আসছি, শিক্ষকদের বেতন কমিশন হওয়া উচিত। এ কমিশন নির্ধারণ করবে কোন শিক্ষকের বেতন কত হবে। সেটার জন্য শিক্ষানীতিতেও দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। আমরা যদি দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তা করি তাহলে এসব নিয়ে ভাবতে হবে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, অধিকাংশ বোর্ডে ইংরেজি, আইসিটি ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ফল খারাপ হয়েছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো শিক্ষক দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ সংকট কাটাতে সরকারি উদ্যোগে একটি শিক্ষা চ্যানেল চালু করা দরকার। নামিদামি ও ভালোমানের শিক্ষকদের ক্লাস ও কৌশল সে চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবে। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয় ছাড়াও এবার মানবিক বিভাগে ফল খারাপ হয়েছে। আমাদের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি মাননির্ধারক কোনো ব্যবস্থা নয়। তবে কিছু পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজিতে দুর্বলতা অনেক আগের। তাছাড়া আগের পাঠদান এবং এখনকার পাঠদানের অনেক তফাৎ রয়েছে। আগে ছিল ট্রাডিশনাল আর এখন তো ফাংশনাল। এতে শিক্ষকরা কতটা দক্ষতা রপ্ত করতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়। এতে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমরা শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে পারি না।
তাছাড়া ঘন ঘন আমাদের পরীক্ষাটা পরিবর্তন হয়। এতে একটা সিস্টেম রপ্ত করতে করতে আরেকটা চলে আসে। এটাও একটা ফল বিপর্যয়ের কারণ। তিনি বলেন, মফস্বলের শিক্ষার্থীদের আমরা গুরুত্ব কম দিয়ে থাকি। অথচ তারাই সংখ্যার দিক দিয়ে বেশি। আমরা নজর দিয়ে থাকি শাহরের দিকে। এটাকেও পরিমাপ করা হয় না। এছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আইসিটি বান্ধব হওয়ার দিকে তিনি গুরুত্ব প্রদান করেন।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, ইরেজিসহ কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্ন একটু কঠিন হয়েছে। তাই পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমেছে। তবে এ হার ঠিকই আছে।
তিনি বলেন, এখন সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে। আগে মা-বাবা ও অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার তদারকি করত চাপ দিত। কিন্তু এখন সৃজনশীল পদ্ধতির কারণে অনেক শিক্ষিত অভিভাবকরাও তা বোঝেন না। ফলে ছেলেমেয়েদের চাপও দিতে পারেন না। এ পদ্ধতিতে আসলে শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে কিনা তা বোঝা যায় না।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ইংরেজি ও আইসিটি বিষয়ের পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় অন্য বোর্ডের চেয়ে ঢাকা বোর্ডের ফলে আমরা কিছুটা পিছিয়ে গেছি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে সার্বিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ফল নিম্নমুখীর কারণ খুঁজে বের করা হবে। তবে এবার যথাযথ মান বজায় রেখে পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখা হয়েছে। তাছাড়া, এবার পরীক্ষার পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ নকলমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন। এসব কারণেই পাসের হার কিছুটা কম হয়েছে। তবে পাসের হার কম হলেও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।