বাঙালির আলী সাহেব
সৈয়দ মুজতবা আলী। তার পরিচয় বহু ভাষাবিদ, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, অনুবাদক ও সবচেয়ে বেশি পরিচয় একজন রম্য-সাহিত্যিক হিসেবে। পাশাপাশি বাঙালি শিশু-কিশোরদের কাছে তিনি বেশি জনপ্রিয় ভ্রমণকাহিনী জনক হিসেবে। কেননা আফগানিস্তান, কাবুল, পাগমানের বরফাচ্ছাদিত শ্বেত-শুভ্র পাহাড় কিংবা দূরদেশের খাদ্য-সংস্কৃতির নিরেট বর্ণনা সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো আর কে-ই’বা দিতে পারে।
তিনি বাংলা’র পাশাপাশি ফরাসি, ফারসি, আরবিসহ মোট ২৩টি ভাষা জানতেন। বহু ভাষাবিদ এই লেখকের ভাষাগত মুনশিয়ানা তার লেখায় সব সময়ই পাওয়া যায়। উদ্ধৃতি কিংবা উদাহরণ হিসেবে ঝোপ বুঝে এমন কোপ কয়জন-ই’বা দিতে পারেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর সহধর্মিণীর অভিযোগ ছিল তাদের ছেলেমেয়েরা তার (সৈয়দ মুজতবা আলী) মতো হয়েছেন, এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তার নির্লিপ্ত জবাব ছেলেমেয়েদের বলো না আমার মতো ২৩টা ভাষায় কথা বলতে!
যত কঠিন সময়ই আসুক না কেন, সত্যরে লও সহজে-এমন ব্রত আপনি করতেই পারেন। কিন্তু, একটি নিরেট, নির্ভেজাল কিংবা শুভ্র-সত্যকে আপনি কিভাবে অন্যের মনঃক্ষুণ্ণ ভাব না এনে প্রকাশ করবেন? তার প্রাঞ্জল উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা আলী। হাসতে হাসতেও যে কঠিন সত্য বলে দেওয়া যায়, তার স্পষ্ট ও বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছেন তিনি।
তার রচিত ছোটগল্প ,অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনী ও উপন্যাসের সংখ্যা ৩০টি। এর মধ্যে দেশে-বিদেশে, জলে ডাঙ্গায়, ময়ূরকণ্ঠী, চাচা কাহিনী ও পঞ্চতন্ত্র অন্যতম। তবে সৈয়দ মুজতবা আলী’র কালজয়ী উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয় শবনমকে। তুর্কী বংশোদ্ভূত তরুণী শবনমের সাথে বাঙালি যুবকের প্রথম দেখা, প্রেম ও হারিয়ে যাওয়ার পরিশীলিত দলিল এটি।
বহু ভাষাবিদ এই লেখক কর্মজীবনও পার করেছেন বহু কর্মের মাধ্যমে। বাবার চাকরি ও নিজের পড়াশোনার সুবাদে বিভিন্ন স্থানে থাকা ও নানাবিধ মানুষের সাথে তার পরিচয় সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় ফুটেছে সাবলীলভাবেই। দেশে ও দূরদেশে নানাস্থান ও নানা কর্মপদে যুক্ত থাকলেও তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়ই পার করেছেন শিক্ষকতা ও সাহিত্য রচনায়।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব এর শিক্ষার্থী ও এই শিক্ষকের ধর্ম-দর্শন নিয়ে তার বড়ভাইয়ের মন্তব্য ছিল অনেকটা হতাশার। সৈয়দ মুজতবা আলীর সাহিত্যে কখনো ধর্মীয় সংকীর্ণতা যেমন ছিল না, তেমনি কখনো অতি উদারীকরণও ছিল না। কিন্তু, তার এই মার্জিন মেনে চলা অর্থাৎ এমন উদারতার জন্য ধর্মীয় গোঁড়া স্বধর্মীদের দল তার সমালোচনা করতে কখনো কুণ্ঠিত হয়নি কিংবা কোনোদিন ক্ষমা করে কথা বলেনি। যখন যেখানেই ছিলেন প্রবল রসাত্মক এই লেখক সময়কে আপনার করেছেন স্বমহিমায়। কঠিন সত্যকেও বলছেন সহজ-সরল হাস্যরসে।
“বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না,” কিংবা সুন্দরীর ঠোঁটের লিপস্টিক ডার্ট নয়, যখন তা আমার ঠোঁটে লাগে তখন তা হয় ডার্ট(ময়লা)” এমন সব বিখ্যাত উক্তি তো রম্যপ্রিয় বাঙালির মুখে মুখেই। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নকল করে ‘আজকে ছুটি’র নোটিশ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জব্দ কৃত গাঁজা পোড়ানোর পর সে রাতে হাতি, ঘোড়া কিংবা জীপে করে বাড়ি ফেরার নির্ভেজাল বর্ণনা তো তার ছোটগল্পেরই অনন্য সৃষ্টি।
আরও পড়ুন : স্কলারশিপ নিয়ে আয়ারল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার সুযোগ
সবিশেষে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখক জীবনের গোঁড়ার দিকে যখন তিনি জনপ্রিয় হচ্ছেন তখন প্রতিদিন তাকে দেখতে পাঠকরা তার বাড়িতে আসতেন এবং জানতে চাইতেন তিনি কিভাবে এমন সব সাহিত্য রচনা করেন। তখন তিনি এক বিলেতি সাহিত্যিককে উদ্ধৃত করে বলেছেন, “আপনি চাইলে আমার সন্তানদের দেখাতে পারি, কিন্তু, সন্তান কিভাবে উৎপাদন করি তা তো আর দেখাতে পারবো না!” এমন নির্লিপ্ত সত্য জবাবে হয়তো কেউ আর কখনো সৈয়দ মুজতবা আলী-আপনার সন্তান উৎপাদন(সাহিত্য কীভাবে রচনা করতে হয়) জানতে না চাইলেও তার রম্য সাহিত্য রসিক বাঙালির দল যুগ যুগ ধরেই জানতে চাইবে। চির রসিক ও সত্যপ্রিয় এই বাঙালি সাহিত্যিক জন্মেছিলেন ইতিহাসের আজকের এই দিনে। জন্মদিনে সৈয়দ মুজতবা আলী’র প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনি বাঙালি মানসপটে যুগ থেকে যুগান্তরে বেঁচে থাকুন বাঙালির একজন আলী সাহেব হয়ে।