দক্ষিণ এশিয়ায় অনন্য মাভাবিপ্রবির ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ

মাভাবিপ্রবির সিপিএস বিভাগের প্রবেশদ্বার
মাভাবিপ্রবির সিপিএস বিভাগের প্রবেশদ্বার   © সংগৃহীত ছবি

'ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) বিভাগ' নামটি যেমন কৌতূহল প্রবণ তেমনি এই বিভাগ সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা অনেকের কাছে। মজার বিষয় হচ্ছে ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবর্তীতে এই বিভাগ চালু হয়। আসলে মানুষের অপরাধ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জানার প্রবল আগ্রহ রয়েছে। তবে দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এ বিষয় সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত ছিলোনা।

একটি বাড়ির কক্ষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল, সকল ক্ষেত্রেই যে নানামুখী কর্মকান্ডের বিস্তৃতি, মানুষের ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমানো পর্যন্ত যে চিন্তাভাবনার ব্যাপকতা সকল ক্ষেত্রেই অপরাধ তার অস্তিত্বের জানান দেয়। আর তাই অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনা সাধারণ মানুষের কাছে ভীতিকর হলেও খুব আগ্রহ তৈরি করে। আর এই আগ্রহ কতটুকু পূর্নতা দিয়েছে মাভাবিপ্রবির সিপিএস বিভাগ তা জানার চেষ্টা থাকবে।

প্রথমেই যে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া দরকার তা হলো, কেনো মাভাবিপ্রবির সিপিএস বিভাগ বিএসসি ডিগ্রী দিয়ে থাকে? আসলে এই প্রশ্নের উত্তর খুবই বিস্তর। এটি এমন একটি বিভাগ যার বিস্তৃতি কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ নয়। এই বিভাগের পাঠ্যক্রম সামাজিক বিজ্ঞান এবং টেকনিক্যাল বিজ্ঞান সকল বিভাগের সাথে বহুমুখী শৃঙ্খলে আবদ্ধ। তাই কোনো কোনো শিক্ষক মনে করেন এই বিভাগকে নতুন কোনো ডিগ্রীর আওতায় আনা উচিত।

আরও পড়ুন: সময়মতো ফুল না ফোটায় মালিদের কারাদণ্ড

যাই হোক না কেনো ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রয়োজনীয়তা তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশেও রয়েছে ভেবে এবং অপরাধ বিজ্ঞান ও পুলিশ সায়েন্সকে একাডেমিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০০৩ সালে বিভাগটি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাভাবিপ্রবির সাবেক ও প্রথম উপাচার্য প্রফেসর ড. ইউসুফ শরীফ আহমেদ। তবে দূর্ভাগ্যবশত প্রথম উপাচার্য হিসেবে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব শুরু করার মাত্র সাত মাসের মাথায় এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করলে সদ্য সৃষ্টি হওয়া ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের পথচলা কিছুটা থমকে যায়। এই ধাক্কার পরেও দীর্ঘ ২ দশক পেরিয়ে আজ দৃশ্যমান যে, সিপিএস বিভাগ একটি শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সাফল্য ও গবেষণার মাধ্যমে।

এই বিভাগের পাঠ্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে- অপরাধ বিজ্ঞান পরিচিতি, পুলিশ স্টাডিজ, ক্রাইম ম্যাপিং, ক্রিমিনাল সাইকোলজি, ইনভেস্টিগেশন, ফরেনসিক বিজ্ঞান, মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স, সাইবার ক্রাইম, সন্ত্রাসবাদ, ক্রিমিনোলজিক্যাল রিসার্চ, মনোগ্রাফ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, পলিটিক্যাল সায়েন্স, বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ ব্যবস্থাপনা, আইন পরিচিতি, সাক্ষ্য আইন, দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, মানবাধিকার, পেনোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ইত্যাদি।

বর্তমানে মাভাবিপ্রবির এই বিভাগে ১৫ জন শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে দক্ষিন এশিয়া তথা বাংলাদেশে ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিষয়ে প্রথম অধ্যাপক হয়েছেন এই বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মো. উমর ফারুক। এছাড়া বেশ কিছু শিক্ষক ইতোমধ্যে পিএইচডি ডিগ্রী শেষ করেছেন। বর্তমানে সিপিএস বিভাগের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন শতাধিক।

মাভাবিপ্রবির সিপিএস বিভাগের আরেকটি বিশেষত্ব ও আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে শিক্ষার্থীদের প্রত্যেক বর্ষে একটি করে ফিল্ড ট্রিপ একাডেমিক পড়াশোনার অংশ হিসেবে রাখা হয়। ফিল্ড ট্রিপের স্থান গুলো হলো- বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেশন বিভাগ(সিআইডি),ঢাকাস্থ ফরেনসিক ল্যাব, সারদা পুলিশ একাডেমি, চট্রগ্রাম কোস্ট গার্ড, শিশু উন্নয়ন সংস্থা, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, বাংলাদেশ প্রিজন, পুলিশ স্টাফ কলেজসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা যা শিক্ষার্থীদের যেমন প্রবল কৌতূহলী করে তোলে সেই সাথে বাস্তবতা উপলব্ধি করে হাতে কলমে শেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

এই বিভাগের সাফল্য এবং এই বিষয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার জীবন কতটা সমৃদ্ধ হয়েছে বা হবে? ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স অপরাধ এবং পুলিশ সংক্রান্ত হলেও এর ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ বিষয়ে পড়ার পর সহজেই ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।

এ বিভাগের অন্যতম সাফল্য হলো এ বিভাগ থেকে বিএসসি ও এমএসসি শেষ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৯ জন অত্র বিভাগের শিক্ষক হয়েছেন। শুধু তাই নয়, দেশে এই বিভাগের কার্যক্রম শুরুর এক দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ নামে এবং চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ। উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ দুটির কোর্স কারিকুলামসহ বিভাগ পরিচালনার সকল ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করে মাভাবিপ্রবির সিপিএস বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ। এমনকি চবির সিপিএস বিভাগের তিনজন শিক্ষকের মধ্যে সকলেই মাভাবিপ্রবির সিপিএস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন: ছাত্রজীবনেই যে সফটওয়্যারগুলোর কাজ জানা উচিত

সম্প্রতি দেশের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস' নামে নতুন বিষয় চালু হয়েছে। যেখানে একাডেমিক কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছেন মাভাবিপ্রবির সিপিএস বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ। এছাড়াও আরেকটি সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ চালুর উদ্দেশ্যে একাডেমিক কোর্স কারিকুলাম ও বিভাগের কার্যক্রম পরিচলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মাভাবিপ্রবির একজন শিক্ষককে।

এর বাইরেও বাংলাদেশ পুলিশের সাথে গবেষণায় একচ্ছত্রভাবে কাজ করে এই বিভাগ। দেশের এলজিআরডি এবং সোশাল সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলের সাথেও গবেষণায় কাজ করে এই বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এছাড়াও বাংলাদেশ সোসাইটি অব ক্রিমিনোলজি এন্ড ভিক্টিমোলজি (বিএসসিভি) এবং সাউথ এশিয়ান সোসাইটি অব ক্রিমিনোলজি এন্ড ভিক্টিমোলজি (এসএএসসিভি) এর সদস্য মাভাবিপ্রবির ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ।

ইতোমধ্যেই এ বিভাগ থেকে অনার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করা ১২ টি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে রয়েছে ৬ জন, এডমিন ক্যাডারে ২ জন, আনসার ক্যাডারে ১ জনসহ অন্যান্য ক্যাডারেও বেশ কয়েকজন রয়েছে। ক্যাডার ছাড়াও পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর (এসআই) রয়েছে প্রায় চল্লিশ জন। এছাড়াও দুদক, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে কর্মরত রয়েছে আরও অনেকে।

বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নতুন বিভাগ হিসেবে ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশ ভাল জায়গা তৈরি করেছে। বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি গবেষণা সংস্থা ও ইন্সটিটিউটে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় চাকরিরও সুযোগ বাড়ছে এই বিভাগ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের। আইসিডিডিআরবিসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, দেশের এনজিও ও কোম্পানি (ব্র‍্যাক, ওয়াল্টন) সহ সিকিউরিটি এক্সপার্ট ও অফিসার হিসেবে দেশে বিদেশে নানা সেক্টরে সুনামের সাথে কর্মরত রয়েছে এ বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী।

ইন্টাররেজিওনাল ক্রাইম অ্যান্ড জাস্টিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে জাতিসংঘের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান থাকায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও জায়গা করেছে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া ইউনাটেড নেশনস অফিস অফ ড্রাগ এন্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি), ইন্টারপোল, ইউনিসেফ, ইন্ট্যারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন, ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন অর্গানাইজেশন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্ট্যারন্যাশনাল সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনে ইন্টার্নশীপ ও কাজের সুযোগ আছে এ বিভাগে পড়ার মাধ্যমে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনে কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং সুনামের সাথে কর্মরত রয়েছে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এর বাইরেও এ বিভাগ থেকে পাশ করা বেশ কিছু শিক্ষার্থীর রয়েছে নিজস্ব রিসার্চ ফার্ম।

তবে অনেকের প্রশ্ন হতে পারে এ বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট চাকরির সেক্টর এবং সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট কোটা না থাকা সত্যেও কেনো সরকারি, বেসরকারি উভয় কর্মক্ষেত্রেই এতো বেশি জন শিক্ষার্থী জায়গা করে নিয়েছে? এই অবস্থান সৃষ্টির অন্যতম কারণ হলো এ বিভাগের মাল্টিডিসিপ্লিনারি একাডেমিক পাঠ্যক্রম যা সরকারি বেসরকারি সকল চাকরির ক্ষেত্রে অত্যধিক উপযোগী। এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক, সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি সিপিএস বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করে বলেও জানা গেছে।

এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের অপরাধ বিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোতে ও অস্ট্রেলিয়ার সুনামধন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে এই বিভাগের বেশ কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দেশের বাইরে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করছে।

একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে আশার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞান অন্বেষণ এবং জ্ঞান সৃষ্টি। আর এই উদ্দেশ্যই শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র সহজেই তৈরি করে দিতে পারে। সেটাই প্রমাণ করেছে শুন্য সাফল্য আর শুন্য প্রসার থেকে যাত্রা শুরু হওয়া ভিন্নধর্মী এই ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ দক্ষিণ এশিয়া তথা বাংলাদেশে তার জ্ঞানের জগতকে প্রসারিত ও পরিস্ফুটিত করে। তাইতো শুধু বাংলাদেশে নয় দক্ষিণ এশিয়ায় অনন্য ড. ইউসুফ শরীফ আহমেদের হাতে প্রতিষ্ঠিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ।


সর্বশেষ সংবাদ