১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬:৪৪

বুয়েট-রুয়েট আউট, নিয়োগ পেলেন প্রাইভেটে পড়ুয়া উপাচার্যের মেয়ে

অহনা আরেফিন  © টিডিসি ফটো

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও গুরুত্বর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বুয়েট-কুয়েট-রুয়েটের মতো দেশের প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের নিয়োগ না দিয়ে সম্প্রতি ওই বিভাগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজনকে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

নিয়োগ পাওয়া সেই শিক্ষকের নাম অহনা আরেফিন। তিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে। নাটোরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি’ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গ্র্যাজুয়েট অহনা আরেফিন। এ নিয়ে বশেমুরবিপ্রবিতে সমালোচনার ঝড় ওঠেছে। পাশাপাশি ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

তথ্য মতে. সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে বশেমুরবিপ্রবির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড। বিভাগটিতে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য তিনটি পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন বুয়েটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রথম সারির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নকারী মোট ১৬ জন প্রার্থী।

তবে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ বোর্ডের নিকট যোগ্য মনে হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্নকারী অহনা আরেফিনকে। তাছাড়া তিনজনের বিপরীতে অহনাসহ মোট দুইজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। তবে অপরজন কুয়েটের গ্র্যাজুয়েট।

জানা গেছে, অহনা আরেফিন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিনের মেয়ে। স্নাতক সম্পন্ন করার পর কিছুদিন বেসরকারি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষক হিসেবে এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচিং এন্ড রিসার্চ এ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, অহনা আরেফিনের তুলনায় যোগ্য প্রার্থী থাকলেও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়ে বলেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েরর শিক্ষার্থী হয়েও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ রিজেন্ট বোর্ডে এ নিয়োগ অনুমোদন হয়েছে। এমনকি রিজেন্ট বোর্ডের কার্যবিবরণী স্বাক্ষর হওয়ার পূর্বেই রেজিস্ট্রার কর্তৃক নিয়োগপত্র পেয়ে তিনি তার কর্মস্থলেও যোগদান করেছেন।

এদিকে, ববি উপাচার্যের মেয়ের এই নিয়োগের জের ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমালোচনার ঝড় তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বনাম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তর্ক-বিতর্কের ঝড় উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপেও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মাহমুদ আর তুরাজ নামে এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া যায় অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডেলিস্টরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়।

আরেক শিক্ষার্থী রথীন্দ্রনাথ বাপ্পি লিখেছেন, আহা! কি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সম্প্রদায়! কেউ আত্মীয়বান্ধব আবার কেউ কলিগ বান্ধব। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে হলে এখন উপাচার্যদের আত্মীয় স্বজন হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক জানান, বুয়েট, কুয়েট বা রুয়েট এর মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দিয়ে তৃতীয়/চতুর্থ ক্যাটাগরির কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কোনো শিক্ষার্থীকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য লজ্জাজনক। এখানে ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অশুভ লক্ষন।

তাদের মতে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কিংবা প্রভাবশালী কারও খুঁটির জোরেই এমনটি হতে পারে। তাছাড়া, কিছু কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সকলের ধারনা একদমই অপ্রীতিকর এমনকি কোন কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট বিক্রি করে থাকে। তাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা চরম হতাশাজনক।

এ বিষয়ে বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড.আবু সালেহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেন্টার অব এক্সিলেন্স এখানে যারা সেরা প্রার্থী তারাই নিয়োগ পাবে বলে মনে করি। একাডেমিক এক্সেলেন্সির পাশাপাশি যদি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় আপত্তির কিছু নেই। তার নিয়োগের ব্যাপারে একাডেমিক নিয়োগ কমিটি, রিজেন্ট বোর্ড অবশ্যই এগুলো আমলে নিয়ে তাকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে মনে করি।

এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, যেখানে সিলেকশন বোর্ড সিলেক্ট হওয়ার পর রিজেন্ট বোর্ডে পাশ হয়েছে সেখানে আমাদের মন্তব্য করার কিছু নাই।

রিজেন্ট বোর্ডের কার্যবিবরণী স্বাক্ষর হওয়ার পূর্বেই যোগদানের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মোরাদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা উপাচার্য স্যার আলাদাভাবে অনুমোদন দিয়েছেন। তবে নিয়োগের বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।

তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নিয়োগ কমিটির চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড.এ কিউ এম মাহবুব বলেন, আইনে বলা হয়েছে সরকারি আধা সরকারি বেসরকারি যে কোন প্রতিষ্ঠানে থেকে পাশকৃত শিক্ষার্থী নেওয়া যাবে, কোথাও বলা নেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে থেকে নেওয়া যাবে না। সিলেকশন বোর্ডে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক, রিজেন্ট বোর্ড কর্তৃক নিয়োগকৃত উচ্চপর্যায়ে লোকজনরা আছেন সিলেকশন বোর্ডে, তারা যেটা ভালো মনে করেছেন সেভাবে সিলেকশন করেছেন। আমরা এর আগে বুয়েট থেকে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়েছিলাম যারা এখানে সমন্বয় করতে পারেনা বলে এখানে স্থায়ীভাবে থাকেনা।

তিনি আরও বলেন, কুয়েট থেকে আসা শিক্ষার্থী ভাইভা বোর্ডে ইংরেজিতে প্রশ্ন করা সত্ত্বেও বাংলায় উত্তর দিয়েছেন যার থেকে বোঝাই যায় তার স্কিল কতদূর। ভালো ক্যাম্পাসে পড়লেই যে শিক্ষার্থী ভালো হবে এমন তো কোন কথা নেই, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যদি ভাইভা বোর্ডে ভালো করতে পারে তাহলে সে তো নিয়োগ পেতেই পারে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি ভালো সিজিপিএ থাকে এবং ভাইবা বোর্ড ফেস করে আসতে পারে তাহলে কেন পাবে না অবশ্যই নিয়োগ পাবে। যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাল আর্টিকেল থাকে ভালো সিজিপিএ থাকে এবং যোগ্যতা থাকে তাহলে তারা কেন অবহেলিত হবে অবশ্যই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবে তারা।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মেয়ে হওয়াতেই অহনা আরেফিনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, তিনি যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সন্তান হতেই পারে তাই বলে কি তিনি মানুষ নয়? তার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার মতো যোগ্যতা আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে তারপর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখানে যদি আমার সন্তান হতো তাহলে আমি নিয়োগ বোর্ডের থাকতে পারতাম না।

এসময় তিনি আরও বলেন, আপনারা আইন বিবেচনা করে দেখবেন আইনে কোথাও কোন উপাচার্যের সন্তানকে নিয়োগ দেয়ার জন্য নিষেধ করা নেই।