ভিসির পদত্যাগে লাভবান শিক্ষকরা, শিক্ষার্থীরা নয়
টানা সপ্তম দিনের মতো আন্দোলন চলছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রূপ নিয়েছে ভিসি বিরোধী আন্দোলনে। অনড় অবস্থানে শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে আমরণ অনশনে বসেছেন ২৮ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরুতে ভিসির অবহেলা ও শিক্ষকদের একটি অংশের ফায়াদা নেয়ার চেষ্টা থেকেই আন্দোলনের মোড় ঘুরেছে।
২০১৭ সালের ১৭ আগস্ট প্রথমবারের মতো অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ শাবিপ্রবির ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০২১ সালের ৩০ জুন দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও দায়িত্ব পান তিনি। শুরুর চার বছর ভালোভাবে শেষ করলেও দ্বিতীয় মেয়াদে এসেই আন্দোলনের মুখে পড়েছেন অধ্যাপক ফরিদ। এলাকাপ্রীতি ও শিক্ষকদের গ্রুপিং সামাল দিতে না পারায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষকদের তিনটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একটি অংশ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ ব্যানারে সক্রিয়। এরা সাবেক অধ্যাপক জাফর ইকবালের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আওয়ামীপন্থীদের আরেকটি পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ ব্যানারে রয়েছেন। তারা ক্যাম্পাসে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বিরোধী হিসেবে পরিচিত। বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল শিক্ষক ফোরাম। এরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। ২০০৮ সালের পর থেকেই আওয়ামীপন্থী দুইটি পক্ষের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বগুলো বণ্টন করে দেয়া হয়।
আরও পড়ুন- ঢাকায় শাবিপ্রবির সাবেক ৫ শিক্ষার্থী আটক
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে ভিসি অধ্যাপক সালেহ উদ্দিনের সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকদের প্যানেল আধিপত্য ফিরে পায়। এসময় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জহির উদ্দিনের স্ত্রীকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দেয়ায় তার অনুসারীরা ভিসি বিরোধী বলয় সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর থেকে পাস করে শাবিপ্রবিতে শিক্ষক হওয়া শিক্ষকরা ছিলেন। অধ্যাপক জহির উদ্দিনও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ২০১০ সালে সিন্ডিকেট নির্বাচনে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আব্দুল মুনিম জোয়ার্দার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দের প্যানেল থেকে নির্বাচন করলে জহির উদ্দিনরা তার বিরোধীতা করেন। ওইদিন রাতেই বিরোধীতাকারীদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃতদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক জহির উদ্দিন, আক্তারুল ইসলাম, রাশেদ তালুকদার ও হাসান জাকিরুল।
বহিষ্কৃতরা পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ নামে আলাদা সংগঠন তৈরি করে। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পর অধ্যাপক আমিনুল হক ভুইয়া। ২০১৫ সালে অধ্যাপক জাফর ইকবাল পক্ষের শিক্ষকরা ভিসির বিরোধীতা করে প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে সবাই পদত্যাগ করেন। তখন পদ টিকিয়ে রাখতে ভিসি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দকে বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে বসান। ২০১৭ সালে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদও তাদের বলয়ে থাকেন। একই সঙ্গে দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে নিজ জেলা কুমিল্লাকে প্রাধান্য দেন। বর্তমানে মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক কবির হোসেন, লাইব্রেরীর দায়িত্বে অধ্যাপক আব্দুল বাতেন, আইআইসিটির পরিচালক অধ্যাপক জহিরুল ইসলাম, মুজতবা আলী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক আবু সাঈদ আরেফিন খান, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক একে এম ফেরদৌস, এপিএস মিঠুর বাড়ি কুমিল্লায়। ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেন অধ্যাপক জহির উদ্দিনকে। প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক আলমগীর কবির। একই প্যানেলের অধ্যাপক সামিউল ইসলাম রাজনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। সিন্ডিকেট, শিক্ষক সমিতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকার পরও দায়িত্ব না পাওয়ায় আওয়ামীপন্থীদের অপরপক্ষ নাখোশ ছিলেন ভিসি অধ্যাপক ফরিদের ওপর। শুধু তিনটি হলের প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন এই শিক্ষকরা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য এক সময়ের শিক্ষক নেতা অধ্যাপক ফরিদের বেশ সুনাম রয়েছে। গত ছয় বছরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বেশ উন্নয়ন করেছেন। বর্তমানে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইউজিসির মতে, আর্থিকভাবে স্বচ্ছ অধ্যাপক ফরিদ। ফলে সরকারের সুনজরও আছেন তিনি। যার কারণে সরাসরি শিক্ষকরা এতোদিন ভিসির বিরোধীতা করতে পারেন নি।
আরও পড়ুন- শাবিপ্রবি ভিসির পদত্যাগ দাবিতে সিলেট অভিমুখে লংমার্চ কাল
আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে সিন্ডিকেট ও মার্চে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে সক্রিয় রয়েছে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দুইটি পক্ষই। বর্তমানে এগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের প্রাধান্য রয়েছে। জানা যায়, সিরাজুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমদ লিজা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের সমর্থক। তার বড় ভাই নাসিম সাইদী একসময়ের ছাত্রলীগ নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ছিলেন। একই সঙ্গে প্রভোস্ট ক্যাটাগরিতে প্রাধাক্ষ্য লিজা সিন্ডিকেট সদস্যও ছিলেন। আন্দোলনের মুখে সিরাজুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ পরিবর্তন করে সহকারী প্রাধ্যক্ষকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনিও ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রক্টরের বিরোধী প্যানেলের ছিলেন। ভিসির এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি অধ্যাপক জহির। যার কারণে প্রক্টরসহ তিনি পুরো ঘটনায়ই চুপ ছিলেন। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা ও পুলিশের অ্যাকশনের সময়ে তারা সামনে থাকলেও শিক্ষার্থীদের পক্ষে কোনো ভূমিকা পালন করেননি।
সূত্র জানায়, বর্তমান ভিসির পুরো সময়ে নৈপথ্যে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন অধ্যাপক জহির উদ্দিন। ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগে তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকায় ভিসিও সুবিধা নিয়েছেন তার কাছ থেকে। ভিসি অধ্যাপক ফরিদের প্রথম মেয়াদে অধ্যাপক জহির উদ্দিন প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ওই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রম কমিয়ে আনেন। শিক্ষার্থীবান্ধব বেশ কিছু প্রোগ্রাম বাতিল করেন বলেও অভিযোগ আছে। এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের অনেকটা কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থীরা ভিসি ও অন্যান্য পদে শাবিপ্রবিতে পড়ুয়াদের মধ্য থেকে দেখতে চান। যার কারণে প্রায় সব ভিসির সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়টি অস্থির ছিলো। আন্দোলনের মুখে বর্তমান ভিসি পদত্যাগ করলে সুবিধা পাবেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদের শিক্ষকরা। এই পরিষদের শিক্ষকরা শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন। গত রবিবার শিক্ষক সমিতি ভিসির পদত্যাগের বিষয়টি দ্রুত সমাধান করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানায়।
আরও পড়ুন- ‘শিক্ষার্থীদের জীবনের চেয়ে আপনার গদি বড় নয়’-চবি অধ্যাপক
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জহির উদ্দিন সরাসরি কিছু বলতে চাননি। তিনি বলেন, আন্দোলন এতোদূর যারা নিয়ে এসেছে তাদের জিজ্ঞেস করুন। আমি বলতে পারছি না। বারবার কল দেয়ার পরও রিসিভ করেন নি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তুলসী কুমার দাস ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ মহিবুল আলম।
এদিকে আন্দোলন হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে ভিসিদের দায়িত্ব থেকে সরাতে চায় না সরকার। বুয়েট, বেরোবি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল ছাত্র আন্দোলন হলেও সরকার ভিসিদের সরিয়ে দেয়নি। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যাতে বিরোধীরা সুযোগ নিতে না পারে সেজন্য ভিসি অপসারণে কঠোর অবস্থানে সরকার।