প্রভোস্ট পদত্যাগের আন্দোলন যেভাবে ভিসি বিরোধী আন্দোলনে রূপ নিলো

শাবিপ্রবিতে ভিসি বিরোধী আন্দোলন
শাবিপ্রবিতে ভিসি বিরোধী আন্দোলন  © সংগৃহীত

১৩ জানুয়ারি। রাত আনুমানিক আটটা। হলের নানা সমস্যা নিয়ে ক্ষুব্ধ বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের ছাত্রীরা হলের ভেতরেই জড়ো হন। তাদের সমস্যার কথা শোনার জন্য প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ লিজাকে ফোন করে হলে আসতে বলেন। শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে হলে আসতে পারবেন না বলে জানান প্রভোস্ট। তখন ছাত্রীরা প্রভোস্টের প্রতিনিধি হিসেবে টিমের অন্য কাউকে পাঠাতে বলেন। ছাত্রীদের অভিযোগ প্রভোস্ট তখন তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। প্রভোস্ট ছাত্রীদের বলেন, আমার এতো ঠ্যাকা পড়ে নাই, কেউ তো মারা যায় নাই। পরে ছাত্রীরা বলেন, যদি না আসেন তাহলে আমরা হল থেকে বেরিয়ে যাব। এর উত্তরে প্রভোস্ট বলেন, বের হয়ে যাও, কোথায় যাবা। লজ্জা থাকলে আর আসবা না!

কথোপকথনের জের ধরে রাত ১১টায় হল থেকে বের হয়ে ছাত্রীরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। দাবি আদায়ে স্লোগান দিতে থাকে। ছাত্রীদের দাবি ছিলো- প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ লিজাসহ প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগ, ছাত্রীবান্ধব নতুন প্রভোস্ট কমিটির নিয়োগ ও হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনার দ্রুত কার্যকর সমাধান। একপর্যায়ে ভিসির বাসার সামনে আসেন ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক জহির উদ্দীন এবং প্রক্টর ড. মো. আলমগীর কবীর। তারা ছাত্রীদের বুঝিয়ে হলে ফেরাতে ব্যর্থ হন। রাত ২টায় বাসা থেকের বের হয়ে আসেন ভিসি অধ্যাপক ফরিদ ‍উদ্দিন আহমেদ। দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে ভিসি পরের দিন ( ১৪ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় তার কার্যালয়ে আসতে বলেন ছাত্রীদের।

আরও পড়ুন- ২৯ ঘণ্টা পর উপাচার্যের বাসভবনে বিদ্যুৎ সংযোগ সচল 

১৪ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ছাত্রীরা ভিসির কার্যালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন। বেলা ১২টার দিকে ছাত্রীদের ১০ জনের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকে বসেন ভিসি। ভিসি অধ্যাপক ফরিদ প্রভোস্ট কমিটি পুর্নগঠনের জন্য এক মাস সময় চান। প্রধান সমস্যার তাৎক্ষনিক সমাধান না পেয়ে ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। ভিসি তখন সাংবাদিকদের বলেন, আমার সাথে যারা আলোচনায় বসেছিলো তারা দাবি বুঝে নিয়ে চলে গেছে। এখন যারা আন্দোলন করছে তাদের আমি চিনি না। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত আন্দোলন করে ছাত্রীরা দাবি মেনে নিতে ভিসিকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেধে দিয়ে ওই দিনের মতো হলে চলে যায় এবং হল অফিসে তালা দেয়। 

পরের দিন ১৫ জানুয়ারি দুপুরের পর আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে জড়ো হয় ছাত্রীরা। এসময় প্রভোস্টের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে ছাত্রীরা। একপর্যায়ে সংহতি জানিয়ে ছাত্রীদের আন্দোলনে বেশ কয়েকজন ছাত্রও শরীক হয়। সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা মৃন্ময় দাস ঝুটনকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর কবীর আন্দোলনস্থলে আসেন। তিনি ছাত্রীদের সার্কেলের ভিতরে ঢুকে তাদেরকে রাস্তার একপাশ ছেড়ে দিতে বলেন। জবাবে ছাত্রীরা বলেন, আমাদের দাবি এখন মেনে নিলে আমরা এখনই পুরো রাস্তা ছেড়ে দিব। প্রক্টর তাদেরকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে সার্কেল থেকে বের হয়ে যান। এর পরপরই পরিবহন দপ্তরের দিক থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজাতে বাজাতে আসলে প্রথমে ছাত্রীরা সাইড দিতে না চাইলেও পরে সাইড দিয়ে দেয়। এসময় ছাত্রীরা তাদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেন। ছাত্রীদের অভিযোগ, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাত্রীদের মারধর করলেও সেখানে উপস্থিত থাকা প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেদিনই বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের সহকারী প্রভোস্ট জোবেদা কনক খানকে ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু প্রভোস্ট টিমের ভিতর থেকে দায়িত্ব দেয়ায় তাকে মেনে নেননি ছাত্রীরা। ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে রাত ১টায় মশাল মিছিল করে ছাত্রীরা। এসময় সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে পরেরদিন (রবিবার) থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। পরে তারা হলে ফিরে যায়। 

আরও পড়ুন- অর্থ দেয়ার অভিযোগে সাবেক দুই শিক্ষার্থীকে আটক

রবিবার সকাল আটটায় প্রধান ফটকে অবরোধের পর গোল চত্বরে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। দুপুরে শিক্ষক সমিতির নেতারা গোল চত্বরে ছাত্রীদের কাছে আসেন। তারাও ছাত্রীদের বুঝতে ব্যর্থ  হন। শিক্ষকরা ফিরে গেলে তাদের পিছু পিছু স্লোগান নিয়ে এগুতে থাকে শিক্ষার্থীরা। এ সময় ভিসি তার কার্যালয় থেকে বের হন। তিনি রেজিস্ট্রার ভবনে একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে যেতে চান। আন্দোলনকারীরা ভিসিকে দেখে তার দিকে এগিয়ে যান। তারা ভিসির সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু সাথে থাকা শিক্ষক ও কর্মকর্তারা ভিসিকে নিয়ে এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইসিটি ভবনে প্রবেশ করেন। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়।

দুপুর ২টার দিকে ভিসি ও প্রক্টরের অনুরোধে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ভিসিকে আইআইসিটি ভবন থেকে মুক্ত করতে পুলিশের ক্রিটিক্যাল রেসপন্স টিমের (সিআরটি) ইউনিটও পৌঁছায় ক্যাম্পাসে। পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অবরুদ্ধ ভবনের তালা খোলার বিষয়ে এবং দাবিগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য কথা বলতে যান শিক্ষকরা। আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে এক পর্যায়ে হঠাৎ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছোড়ে। পুলিশ রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেণেড নিক্ষেপ করে। এতে অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন বলে দাবি আন্দোলনকারীদের। সেদিন রাত ৮ টার পর পুনরায় প্রধান ফটকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। রাত ৯টার পর জরুরি সিন্ডিকেট সভা করে ভিসি অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন এবং সোমবার ( ১৭ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার ভিতরে হল ত্যাগের নির্দেশ দেন। সেসময় বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট হিসেবে অধ্যাপক ড. নাজিয়া চৌধুরীকে প্রভোস্ট হিসেবে দায়িত্বও দেন তিনি।

আরও পড়ুন- শাবিপ্রবিতে অনশনকারী আসিফের পাশে তার বাবা

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও হল খালি করার নির্দেশের প্রতিবাদে রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জরুরি বৈঠক করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নিন্দা জানান এবং পুলিশের হামলার প্রতিবাদে উপাচার্যের পদত্যাগসহ ৩ দফা দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেন।

সোমবার হল ত্যাগ না করে গোলচত্বরে জড়ো হতে থাকেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সে সময় তারা ৩ দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো হলো: উপাচার্যের পদত্যাগ, শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলায় জড়িত সবার জবাবদিহি ও উপাচার্যের প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা। আন্দোলনকারীরা এদিন ভিসিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'অবাঞ্ছিত' ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বরাবর চিঠি পাঠানোর ঘোষণা দেন।

রোববার ঘটনা তদন্তে গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদারকে প্রধান করে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। চলমান আন্দোলনে বহিরাগতরা নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন ভিসি। আন্দোলনকারীরা এ দাবি নাকচ করে ভিসি মিথ্যাচার করছে বলে দাবি করেন।  ওই দিনই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কার্যালয়, প্রশাসনিক ভবন ও সব একাডেমিক ভবনে তালা দেন। তবে ভর্তি কার্যক্রম বিবেচনায় তারা রেজিস্ট্রার ভবন তালা দেননি। বিকেল ৪টা থেকে ভিসির বাসভবনের রাস্তায় প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। ফটকের সামনে প্রচুর সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। রাত সাড়ে ১০ টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য আব্দুল হামিদ বরাবর খোলা চিঠি পাঠ করেন। চিঠিতে তারা অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের অপসারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা ও নতুন ভিসি নিয়োগের দাবি জানান। সারারাত ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। রাষ্ট্রপতি বরাবর লেখা খোলা চিঠি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকঘরের মাধ্যমে বঙ্গভবনে পাঠান তারা। দাবি মেনে নিতে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতিকে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেধে দেন। ওইদিনই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানায় আওয়ামী লীগ। শিক্ষার্থীদের দেখতে প্রতিনিধি দল পাঠান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। সরাসরি গিয়ে দেখা করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। তার প্রচেষ্টায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনির সাথে ভার্চুয়ালি বৈঠক করে শিক্ষার্থীরা। তবে আলোচনা ফলপ্রসু হয়নি। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি দলও শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে বলে সাংবাদিকদের জানান।

আরও পড়ুন- আন্দোলনে বহিরাগতদের ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ নাকচ

এদিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাবি মেনে না নেয়ায় বুধবার ২৪ শিক্ষার্থী আমরণ অনশন শুরু করে। পরে একজন বাড়ি চলে যায়। ২২ জানুয়ারি অনশনকারীদের সাথে আরও ৫ শিক্ষার্থী যোগ দেন। অনশনকারীদের মধ্যে বর্তমানে ২০ শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ভিসির বাসবভনের জরুরি পরিষেবাগুলোর লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়। শিক্ষকদের একটি অংশ ভিসির জন্য খাবার নিয়ে যেতে চাইলেও শিক্ষার্থীরা তাদের যেতে দেননি। শিক্ষার্থীরা বলেন, ভিসির জন্য তারা খাবার পাঠাবেন। পরে গতকাল রাতে ভিসির বাসায় পুনরায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের অনশন এখনো চলছে।


সর্বশেষ সংবাদ