ওরা পাইলটও হতে পারছে না, বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হতে পারছে না
শৈশবে তাদের স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে পাইলট হবে। আকাশে উড়বে। উচ্চমাধ্যমিক শেষে সেই স্বপ্ন পূরণের প্রাথমিক ধাপও অতিক্রম করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া-ভিত্তিক বেসরকারি পাইলট প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান আরিরাং ফ্লাইং স্কুলে ভর্তির জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হয়েছিল ২০তম ব্যাচের ১৬ শিক্ষার্থী।
এরপর ভর্তির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও ক্লাস শুরুর অনুমতির অভাব, বিমানবন্দরে হ্যাঙ্গামর স্থানান্তরসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে ২০২০ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ভর্তি নেয়নি দেশের সর্ববৃহৎ এই ফ্লাইট ট্রেনিং একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে, ভর্তির বিষয়ে আরিরাং কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ থাকায় ওই শিক্ষার্থীরা অন্য কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও অংশ নিতে পারেনি। ফলে ঝুলে আছে আরিরাং ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হতে চাওয়া ১৬ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।
শিক্ষার্থীদের ভর্তি না নেওয়ার বিষয়ে একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, ঢাকা এয়ারপোর্টের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালে হ্যাঙ্গামর স্থানান্তরের কাজের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সময়মত তাদেরকে নতুন ব্যাচের ক্লাস শুরুর অনুমতি দেয়নি। তখন তাদের চেয়ারম্যানও ক্লাস বন্ধের নির্দেশ দেয়। তাই তারা ক্লাস শুরু করতে পারছেন না। অন্যদিকে, প্রায় এক বছর পরেও ভর্তি হতে না পেরে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ কোরিয়া-ভিত্তিক শিল্প গ্রুপ ইয়াংওয়ানের মালিকানাধীন আরিরাং এভিয়েশন লিমিটেড এর তত্ত্বাবধানে দেশের স্বনামধন্য এবং অন্যতম বৃহৎ ফ্লাইট ট্রেনিং একাডেমি আরিরাং ফ্লাইং স্কুল ২০১০ সাল থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। যাত্রার শুরু থেকে সুনামের সাথে ফ্লাইট ট্রেনিং এর কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও করোনা মহামারী শুরুর পরে নামে বিপত্তি।
২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ট্রেনিং কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেয়। তবে তার দুইদিন পরই বেবিচক (বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে ফেরত আসে তারা। সেই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর তারা নতুন ব্যাচের (ব্যাচ ২০) ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে বাংলাদেশ বিমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (বিএটিসি) প্রায় একশ জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে ২৪ জনকে এবং তাদের মধ্য থেকে বাছাই শেষে ১৬ জনকে ভর্তির জন্য চূড়ান্ত করা হয়।
এরপর নিয়মানুসারে বেবিচক সদর দপ্তরে বাছাইকৃত সেই ১৬ শিক্ষার্থীর মেডিকেল এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তাদেরকে ভর্তির জন্য টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তাদের ১৬ জনকে নিয়ে আরিরাং কর্তৃপক্ষ তাদের উত্তরা অফিসে একটি গেট টুগেদারের আয়োজন করে স্কুলের নিয়মকাননু, প্রশিক্ষণ চলাকালীন করণীয়, বৈমানিক পেশার দিকনির্দেশনা এবং ভর্তির নির্দেশনা সম্পর্কে জানায়। ওই সভায় ফ্লাইং স্কুলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), চীফ ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর (সিএফআই) এবং কোর্স কোঅর্ডিনেটরসহ প্রশাসনিক বিভাগের অধিকাংশ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
ওই মিটিংয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের বেবিচকের সিকিউরিটি ফর্ম দিয়ে ভর্তি নিশ্চিতের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত ১০ লক্ষ টাকা কোথায় কিভাবে জমা দিতে হবে তাও বলে দেয়া হয়।
শিক্ষার্থীরা জানায়, নির্দেশনা অনুসারে তারা ভর্তির টাকা জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু গত ৩ মার্চ স্কুল কর্তৃপক্ষ এক মেইলের মাধ্যমে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সবাইকে টাকা জমা দেওয়া থাকতে বিরত থাকতে বলে।
ওই ই-মেইলে ঢাকা এয়ারপোর্টের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালে বেবিচকের হ্যাঙ্গামর স্থানান্তরের নির্দেশনাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে নতুন ব্যাচের ক্লাস ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে শুরু করা হবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু জুনে ক্লাস শুরুর সেই আশ্বাস সেপ্টেম্বরে এসে ভর্তি না নেওয়ার সিদ্ধান্তে গিয়ে ঠেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০তম ব্যাচের ভর্তিচ্ছু এক শিক্ষার্থী জানান, এই সময়ের মধ্যে স্কুল কর্তৃপক্ষ কখনো বেবিচক থেকে ক্লাস শুরুর অনুমতির অভাব, কখনো হ্যাঙ্গামর স্থানান্তর এ সময় বেশি লাগার কারণ, কখনো করোনা মহামারীর জন্য ক্লাস শুরু করতে না পারাকে কারণ দেখিয়ে বার বার তারিখ পেছাতে থাকে।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, এতকিছুর পরেও শিক্ষার্থীরা যখন ভর্তি ও ক্লাস শুরুর অপেক্ষায় ছিল তখন গত ১৫ সেপ্টেম্বর স্কুল কর্তৃপক্ষ ব্যাচ ২০ এর ১৬ শিক্ষার্থীকে একটি ইমেইলের মাধ্যমে জানায় যে, কর্তৃপক্ষ এখনো নতুন ব্যাচ চালু করার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং শিক্ষার্থীরা চাইলে তাদের সুবিধা অনযায়ী অন্য কোথাও তাদেরকে যুক্ত করতে পারে। পরবর্তীতে যদি কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে সবাইকে জানানো হবে।
কর্তৃপক্ষের এমন মেইলে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আরিরাং ফ্লাইং স্কুলে ভর্তি হতে চাওয়া ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছে।
নিজের হতাশা প্রকাশ করে এক শিক্ষার্থী বলেন, দেশের অন্যতম সেরা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। স্বপ্ন ছিলো বৈমানিক হওয়ার। তাই আরিরাং এর শর্ত মোতাবেক কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। এই মূহুর্তে যদি আরিরাং এইভাবে আমাদের ব্যাচের ক্লাস বন্ধ করে দেয় তাহলে তো আমাদের ক্যারিয়ার বলতে কিছুই থাকলো না।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবের সামনে প্রতিনিয়ত বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া লাগছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিষণ্ণতায় ভুগছি ক্যারিয়ার নিয়ে, এভাবে চলতে থাকলে আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না।
তাদের এই অবস্থার জন্য আরিরাং কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, আরিরাং কর্তৃপক্ষ বিগত ৯ মাস ধরে আমাদের ভর্তির কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু তারা কখনোই বলেনি যে ক্লাস শুরু করার ব্যাপারে তাদের চেয়ারম্যান এর নিষেধাজ্ঞা আছে। সবকিছু জেনেশুনেও তারা আমাদের কাছে অনেক বিষয় গোপন করেছে, যার ভুক্তভোগী এখন আমরা ১৬ জন।
বেবিচক চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তার আছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, ভিক্ষা হিসেবে হলেও আমাদের ক্যারিয়ার রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন, বলেন ওই শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীদের এই খারাপ অবস্থায় দুশ্চিন্তায় আছেন তাদের অভিভাবকেরাও। না প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আরিরাং এ কোর্স চলাকালীন আরিরাং এর অনুমতি ব্যতীত অন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা কোন চাকরি বা ব্যবসায় সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাই ওই শিক্ষার্থীদের কেউই কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেননি কিংবা অন্য কোথাও ভর্তিও হননি। কিন্তু এত অপেক্ষার পরে আরিরাং কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে জানান ওই অভিভাবক।
এ বিষয়ে কোরিয়ান নাগরিক আরিরাং ফ্লাইং স্কুলের চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে আরিরাং ফ্লাইং স্কুলের ট্রেনিং এন্ড সিজিআই প্রধান আনিসুজ্জামান খান বলেন, আমাদের চেয়ারম্যানের নির্দেশে নতুন ব্যাচে ভর্তির কার্যক্রম বন্ধ আছে। কবে নাগাদ তা চালু হবে কিংবা আদৌ চালু হবে কিনা তা কেবলমাত্র চেয়ারম্যানই বলতে পারবেন।
বাংলাদেশে আরিরাং ফ্লাইং স্কুলের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যেতে পারে জানিয়ে আনিসুজ্জামান বলেন, চেয়ারম্যান স্কুলটি চালু রাখবেন কিনা তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। হয়তো বন্ধও করে দিতে পারেন। তবে নতুন ব্যাচের বিষয়ে আমাদেরকে তিনি সর্বশেষ বলেছেন, ‘আই অ্যাম নট ইয়েট ডিসাইডেড টু কনিটিনিউ।’ এজন্য এ বিষয়ে আমাদেরও করার কিছু নেই।
শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, ভর্তিচ্ছু ওই ১৬ জন এখনো অফিসিয়ালি আমাদের শিক্ষার্থী হননি। আমরা তাদেরকে অনেক আগেই ভর্তি বন্ধের বিষয়টি জানিয়ে বলেছি, তারা চাইলে অপেক্ষা না করে অন্যত্র চলে যেতে পারে। আমাদের এখানে ভর্তি অনিশ্চিত।
তবে নতুন ভর্তি শুরু হলে সিলেক্টেড ওই শিক্ষার্থীদেরই আগে জানানো হবে বলে জানান তিনি।