২০ শতাংশ ‘ফরিদপুর কোটা’র প্রস্তাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়
গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ২১তম একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের জন্য ২০ শতাংশ কোটা প্রস্তাব করা হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত সভায় এ প্রস্তাব করা হয়। ২০ শতাংশ কোটার এই প্রস্তাব করার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ফেসবুক গ্রুপে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থীর জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এ ধরনের আঞ্চলিক কোটার বিপক্ষে। ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুল হাসান মোল্লা বলেন, ‘২০১৯ সালে আমরা যখন সাবেক উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের জন্য আন্দোলন করেছিলাম তখন ভিসি কোটার বিষয়টা ছিলো অন্যতম। আমরা মূলত চেয়েছিলাম বৈষম্যহীন ক্যাম্পাস। কিন্তু ২০ শতাংশ কোটা আমাদের সেই বৈষম্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যারা বৃহত্তর ফরিদপুরের মেধাবী শিক্ষার্থী তাদের জন্যও এটা লজ্জাজনক। কারণ তারা যখন মেধাতালিকার মাধ্যমে ভর্তি হবে, অনেকে তাদের কোটা হিসেবে বিবেচনা করবে। বিষয়টি তাদের জন্য কষ্টকর হবে। তাই আমরা আশা করি, একজন শিক্ষার্থী বান্ধব উপাচার্য হিসেবে বিষয়টি বিবেচনা করবেন।’
মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আবুল বাশার কৌশিক বলেন, ‘অযৌক্তিক কোটা সংস্কৃতির মাধ্যমে তৈরি বৈষম্য সর্বদাই মেধাবীদের সাফল্যের পথে এক বড় বাধা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে একটি অঞ্চলের জন্য ২০ শতাংশ কোটা রাখা হলে এর মাধ্যমে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মানই নিম্নগামী হবে না, বরং বৈষম্যের নতুন সংস্কৃতির উত্থান হবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং জাতীয় স্বার্থে এমন অযৌক্তিক প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। পাশাপাশি প্রশাসনের নিকট দাবি জানাচ্ছি, এ ধরনের কোটা বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান বৃদ্ধিতে আরো বেশি মনোযোগী হওয়ার।’
এমন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আঞ্জুমান আরা বলেন, ‘যখনই কোনো জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় তখন তাদেরকে সকলে পৃথক সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচনা করে। এমনকি তারা নিজেরাও নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা বিবেচনা করে। আর এর ফলে একসময় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জটিলতা তৈরি হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটিই এমন একটি শব্দ, যেটি থেকে বোঝা যায় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য নয়। এখানে সকলের অধিকার সমান। কিন্তু যখনই একটি অঞ্চলের জন্য কোটা রাখা হবে, তখনই বৈষম্য তৈরি হবে। তাই সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে আমি মনে করি, এই ২০ শতাংশ কোটা না রাখাই ভালো হবে। এমনকি এই কোটার বিরুদ্ধে রয়েছেন বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও।’
লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ফরিদপুর জেলার সাদমান সাকিব রক্তিম বলেন, ‘এ ধরনের কোটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভার্তির ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার পাওয়া উচিত। এখানে কোনো অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য কাম্য নয়।’ আর আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত মাদারীপুর জেলার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য ২০ শতাংশ কোটা অন্যান্য অঞ্চলের প্রতি বৈষম্যমূলক। এই কোটা চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাণিজ্যও হালাল রুপ পাবে বলে আমি মনে করি।’
এদিকে, শুধু শিক্ষার্থীরাই নয় এই কোটার বিপরীতে অবস্থান জানিয়েছেন শিক্ষকরাও। মানবিক অনুষদের ডিন আশিকুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, ‘অঞ্চলভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে মেধার ভিত্তিতে, এলাকার ভিত্তিতে নয়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পাই ৬৪ জেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু বঙ্গবন্ধুর নামে, আমরা আশা করি এটি আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় হবে। এখানে ৬৪ জেলার শিক্ষার্থীরাই পড়ালেখার সমান সুযোগ পাবে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহত্তর ফরিদপুরের জন্য ২০ শতাংশ কোটা থাকবে এমনটি আমি আশা করি না।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক এবং শিক্ষক সমিতির প্রচার সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘২০ শতাংশ কোটার সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার পরিপন্থী এবং অনৈতিক একটি সিদ্ধান্ত। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তথা সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।’
এছাড়া এ বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য না করলেও মার্কেটিং বিভাগের সভাপতি ইমরান হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি কি সেটি সকলের বোঝা উচিত। এই ধারণা অক্ষুন্ন রাখাসহ শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কাজ করা উচিত।’
প্রসঙ্গত, একাডেমিক কাউন্সিলের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলে বশেমুরবিপ্রবি ব্যতিত অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় এই অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে কোটার প্রস্তাবটি দেয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ.কিউ.এম মাহবুব জানিয়েছেন, প্রস্তাবটি প্রথমে রিজেন্ট বোর্ড এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারের নিকট পাঠানো হবে। আর তাদের মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।