বশেমুরবিপ্রবির নতুন ভিসির সামনে যত চ্যালেঞ্জ
প্রায় ১১ মাস পর নতুন উপাচার্য পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তৎকালীন উপাচার্য ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের পর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য দিয়েই চলছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। গত বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. এ. কিউ. এম মাহবুবকে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
নতুন উপাচার্য নিয়োগের ফলে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যা চলমান থাকায় নতুন উপাচার্য যোগদানের পরপরই বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় হলো:
কম্পিউটার চুরির রহস্য এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা দ্বন্দ্ব: গত ঈদুল আজহার ছুটিতে বশেমুরবিপ্রবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থেকে ৪৯ টি কম্পিউটার চুরি হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজন গ্রেফতার এবং ৩৪ টি কম্পিউটার উদ্ধার হলেও এখনও জানা যায় নি মূলহোতাদের পরিচয়, উদ্ধার হয়নি অবশিষ্ট ১৫ কম্পিউটার ও। এছাড়া এ ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে কয়েকজন শিক্ষক ও এক কর্মকর্তার মাঝে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে।
তিনজন শিক্ষক অভিযোগ করেছেন তারা সহকারী রেজিস্ট্রার মোঃ নজরুল ইসলামের দ্বারা হুমকির শিকার হয়েছেন। অপরদিকে, মোঃ নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় শিক্ষক সমিতি এবং কর্মকর্তা সমিতি পাল্টাপাল্টি বিবৃতি প্রদান করছে। এছাড়া কম্পিউটার চুরির মূলহোতাদের বিচারের পাশাপাশি শিক্ষকদের হুমকি প্রদানের বিচার চেয়ে শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে এবং বিচার নিশ্চিত না হলে কঠোর পদক্ষেপের হুশিয়ারী দিয়েছে।
পড়ুন: পরীক্ষার নয় মাসেও ফল পায়নি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
অনুমোদনহীন বিভাগ: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে বশেমুরবিপ্রবিতে ইতিহাস বিভাগ চালু করা হয়। এরপর প্রায় তিন বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত বিভাগটির অনুমোদন মেলেনি বরং ইউজিসি পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভাগটিতে ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারী থেকে অনুমোদনের দাবিতে বিভাগটির শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে।
ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শরিফুল ইসলাম সোহাগ বলেন, আমরা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো। আশা করি তিনি দ্রুত বিষয়টি সমাধান করবেন অন্যথায় আমরা আবারও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।”
ইটিই এবং ইইই বিভাগ একীভূতকরণ: ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন (ইটিই) বিভাগকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং(ইইই) বিভাগের সাথে একীভূতকরণের দাবিতে ২০১৯ এর অক্টোবর থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলন শুরু করে ইটিই বিভাগের শিক্ষার্থীরা। ইতিমধ্যে অনেক বিভাগে অনলাইন ক্লাস শুরু হলেও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
এ বিষয়ে বিভাগটির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র কামরুল হাসান মোল্লা বলেন, নতুন উপাচার্যকে আমরা সময় দেবো। আশা করি তিনি দ্রুত আমাদের বিষয়টি সমাধান করবেন। অন্যথায় পুনরায় আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হবো।
শিক্ষকবিহীন বিভাগ ও ইনিস্টিউট: ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হওয়া ইতিহাস বিভাগ, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হওয়া আর্কিটেকচার বিভাগ, ফুড অ্যান্ড এগ্রোপ্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট চলছে নিজস্ব কোনো শিক্ষক ছাড়াই৷ এমনকি বিভাগগুলোতে রয়েছে ল্যাবরুম এবং ক্লাসরুম সংকটও।
শেখ হাসিনা আইসিটি ইনিস্টিউটের ছাত্র সাগর দে বলেন, আমরা সমস্যা সমাধানে উপাচার্যের সাথে আলেচনা করবো। যদি সমস্যা সমাধান না হয় তাহলে আমরাও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
ক্রেডিট ফিসহ বিভিন্ন খাতের ফি হ্রাস করা: ক্রেডিট ফি, কেন্দ্র ফি, চিকিৎসা ফি হ্রাস করাসহ ১৪ দফা দাবিতে ২০১৯ এর নভেম্বরে আন্দোলন শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে বিষয়গুলো রুটিন দায়িত্ব পালনকারী উপাচার্যের এখতিয়ারের বাইরে হওয়ায় আন্দোলন স্থগিত করা হয়। তবে নতুন উপাচার্য নিয়োগ হওয়ায় তারা পুনরায় দাবিগুলো উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ বিষয়ে গণিত বিভাগের ছাত্র মোহাম্মদ মাহাদী হাসান বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর পর বিষয়গুলো নিয়ে উপাচার্যের সাথে আলোচনা করবো এবং আলোচনা সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নিবো। এসময় তিনি জানান তারা নিজেদের দাবি আদায়ে অনড় থাকবেন।
দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারীদের নিয়োগ স্থায়ীকরণ: নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতায় প্রায় ১৩ মাস যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়টির দৈনিক মজুরি ভিত্তিক ১৭৬ জন কর্মচারীর বেতন বন্ধ রয়েছে। আর বকেয়া বেতন, চাকরি স্থায়ীকরণসহ তিন দফা দাবিতে ২০১৯ এর নভেম্বর থেকে আন্দোলন করছেন এসকল কর্মচারীরা।
দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী ইব্রাহিম খান বলেন, আমরা উপাচার্যের সাথে বিষয়টি সমাধানের জন্য আলোচনা করবো পাশাপাশি শান্তপূর্ণ আন্দোলন অব্যাহত রাখবো।
পড়ুন: ভিসিকে আল্টিমেটাম, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে যাচ্ছে নোবিপ্রবি শিক্ষকরা
চলমান এসব সমস্যা ছাড়াও দীর্ঘদিন যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আবাসন সংকট, অধ্যাপক সংকট, ল্যাবরুম সংকট, ক্লাসরুম সংকট রয়েছে। বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে বর্তমানে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাচ্ছে। এছাড়া ২০টি বিভাগে ক্লাসরুম সংকট আর ১০টি বিভাগে ল্যাবরুম সংকট রয়েছে এবং ২৯ টি বিভাগে একজনও অধ্যাপক নেই। এর পাশাপাশি প্রায় ৫ বছর পার হলেও এখনো বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, শহীদ মিনার, অডিটোরিয়াম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক নির্মাণ হয়নি।
এ বিষয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. এ. কিউ. এম মাহাবুব দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সরকার বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করলেও এখনো দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। তাই এসব বিষয়ে এখন কোন মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।
তবে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের কল্যাণে এ বিশ্ববিদ্যালয় সর্ম্পকে অনেক কিছু শুনেছি। দায়িত্ব নেয়ার পর সবার সহযোগিতায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কাজ করবো।
প্রসঙ্গত, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে গতবছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন।