কেমন আছে করোনাকালের চুয়েট
কাক ডাক ভোর, আর পাখির কিচিরমিচিরের শব্দে ভাঙত ঘুম। জানালা দিয়ে সূর্য মামার মৃদু নজরখানির পলক যেন পড়েই না। সকাল সকাল নাস্তা-পানি সেরে নয়টার ক্লাসে দৌঁড়াতে হতো, এ দৌঁড় মারাথনের মতো নয়, স্প্রিন্টের রেখায় অশ্বের চেয়েও দ্রুত। ক্লাস শেষ দুপুর দেড়টায়, ক্লান্ত পথিকের মতো বিরতির সময়টা নিজেকে প্রোজ্জ্বল করে আবার ল্যাবের তাড়া। দুপুর আড়াইটা থেকে বিকল ৫টা পর্যন্ত প্রকৌশল বিদ্যার এই পরীক্ষণ ক্লাসগুলো শিক্ষার্থীদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলায়। তবু এই ব্যস্ত রুটিনে অভ্যস্ত প্রতিটি শিক্ষার্থীর দেহের সর্বাঙ্গ। সন্ধ্যা নেমে আসছে, নীড়ের পাখি ঘরে ফিরতে শুরু করছে। আর প্রিয়জনের ফেরার অপেক্ষায় থাকবে বলে বিদায় বেলায়ও শেষ হাসিটা আবারও দেখে নেয় অনেকেই।
দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের একমাত্র প্রকৌশল বিদ্যার বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) এ যেন পুরনো কথা। পাহাড়ের কোল ঘেষে মাস্টার দা সূর্য সেনের স্মৃতি বিজরিত রাউজনের বুকে অবস্থিত এই ক্যাম্পাসে ব্যস্ততা আর প্রিয়জনের ফিরে আসার এমন গল্প নিত্যদিনের। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ২৫ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত এই ক্যাম্পাসে এখন শুধুই নিরবতা।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ছুটি ঘোষণা করায় ক্যাম্পাস এখন পুরোটা নিশ্চুপ। সেই সুযোগে প্রকৃতি যেন নিজের মতো সাজার চেষ্টা করেছে। তবে নেই কোনো কোলাহল, নেই ক্যাম্পাসের সজীবতা। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণটা ফাঁকা পড়ে আছে, নেই সেখানে কোনো আড্ডা। গোলচত্বর নিশ্চুপ। ক্যান্টিনগুলোতেও ঝুলছে তালা। কাশেম মামা কিংবা সাদ্দাম মামার দোকানে চায়ের কাপে ঝড় তোলার দৃশ্যটাও যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে আজ। গল্প-আড্ডায় মেতে থাকা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন চত্বর আর আবাসিক হলগুলো হয়তো চেয়ে আছে আনমনায়। হতাশা চত্বর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ সব আজ খা খা করছে। পরিচিত চত্বরগুলো শিক্ষার্থীর শূন্যতায় যেনো যৌবন হারিয়েছে।
রুটিনমাফিক চলা নিত্যদিনের সঙ্গী পদ্মা, ইছামতি, রুপসা, গোমতি, হালদা, মেঘনা, মাতামুহুরি, সাঙ্গু, বুড়িগঙ্গা, তিস্তা, যমুনা কিংবা সুরমা নামের সেই চুয়েট বাসগুলো মিস করছে চুয়েটের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে। গোলচত্বরে সেই চুয়েট বাসের সারির দৃশ্য আজ আর চোখে পড়ে না। প্রধান ফটক হতে ১০০ গজ দুরের চুয়েট লেকে সৌন্দর্যের হাতছানি আজ দেখার মত। কৃষ্ণচূড়া ফুটেছে তার অপরুপ সাজে। ছুটোছুটি, উড়ো উড়ি, খুনসুটি আর মনের সুখে পাখিগুলো সাঁতার খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে চুয়েট লেকে।
পদ্মপুকুর হয়তো পদ্মফুলে ভরে উঠেছে। হয়তো জলময়ূর এসে বেধেছে নিজের সংসার, নেচেছে ময়ূরনৃত্য। এমন অপরুপ সৌন্দর্য প্রকৃতি নিজেই উপভোগ করছে আজ। বঙ্গবন্ধু হল, শহীদ মোহাম্মদ শাহ হলের বাগানগুলো ভরেছে ফুলের সুবাসে। ক্যাফেটেরিয়াও আজ শূন্যতায় আনমনে। শিক্ষার্থীদের মাঝে তৈরি হয়েছে ক্যাম্পাসের শূন্যতা। নানান ধরণের মতবাদের মধ্যেও সবাই একই সারমর্মে পৌঁছাতে চেয়েছে কবে যাবো ক্যাম্পাসে! দিয়েছে বিভিন্ন আলাপন।
চুয়েটের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জয়ধ্বনির সভাপতি আজহার উদ্দীন প্রকৃতির এই নির্মমতা, আর ক্যাম্পাসে ফেরার আকুতি নিয়ে বলেন, লকডাউনের দিনগুলো খুব বেশি একঘেয়ে লাগা শুরু করছে দিনকে দিন। স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়া মানুষের জন্য ঘরে বন্দি থাকাটা অবশ্যই সুখকর নয়। চুয়েটের থাকাকালীন প্রতিটা দিন-রাতই ব্যস্ততার। কালেভদ্রে দুয়েকটা দিন আসতো অবসরের। অনেক বেশি ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ একটা অবসরের দিন খুব বেশি মজার। কিন্তু অনেক বেশি অবসরের এই সময়ে সেই ব্যস্ত দিনগুলোকে খুবই মিস করা হচ্ছে।
‘হল লাইফ, টিউশনের জন্য চুয়েট বাসের জার্নিটা এই তালিকাকে অবশ্যই দীর্ঘ করে। আমি মনে করি, এই অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি সহ সবার চাওয়া এখন একটাই, ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরুক পৃথিবী, হাসুক সকাল’- যোগ করেন তিনি।
তবে একটু ভিন্নধর্মী ধারণা পোষণের মাধ্যমে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সাব্বির আহমেদ লিখেছেন, একটু বিরক্তিকর যেমন গতিময় জীবন যখন স্থবির হয়ে পড়ে ঠিক সেরকম। তবে পুরো রমজান মাস পরিবারের সাথে পালন করায় একটু ভাল লাগতেছে সচারাচর এরকম সুযোগ পাওয়া যায় না। তবে অবশ্যই চুয়েট লাইফের প্রত্যেকটা মুহূর্ত ভীষণভাবে মিস করি। হল সংলগ্ন ক্যান্টিন ও ২নং ক্যান্টিনের যে আড্ডা সেটা মিস করি। সকালে ঘুম থেকে উঠে ক্লাস ধরা আর সিটি দেওয়ার জন্য যে তোড়জোড় সেটা মিস করি। এই আপদকালীন সময়টা খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাক এইটাই কামনা করি। জনমানুষের জীবনে যে একটা বিপর্যয় নেমে এসেছে তা যেন খুব দ্রুত চলে যায়। আবার ফিরতে চাই সেই স্বাভাবিকের তরে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের উম্মে হাবিবা বুবলি জানান, বাড়িতে খুবই বোরিং দিন কাটছে, সব সময় ক্লাস ল্যাব করে করে অভ্যাস আমাদের। হল, বন্ধু সবকিছুই মিস করি। হতাশা চত্বরে আড্ডা, লেডিস হলে রাত জেগে আড্ডা দেয়া, সবার সাথে গান গাওয়া, গান শুনা-সবই মনে পরছে এখন। আল্লাহ সহায় থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে সেই দিনগুলো ফিরে পাই যেন এটাই প্রার্থনা।
নবাগত ২০১৯-২০ সেশনের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের কামরুজ্জামান সিয়ামকে চুয়েটের ব্যস্ততম দিনগুলো এবং ক্যাম্পাস নিয়ে মনে শুন্যতা বিষয় জানতে চাইলে আবেগঘন হয়ে লিখেন, হ্যাঁ অবশ্যই ক্যম্পাাসকে মিস করি। ক্লাস, ক্লাস শেষে ল্যাব, ল্যাব রিপোর্ট, আর ক্লাস টেস্ট এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। যখন করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি হলো তখন থেকে ব্যস্ততাময় কাজের মাঝে আনন্দটা খুব মনে পরে, রাতে গণরুমের আড্ডা আমাকে আবেগিত করে দেয়।
পরিশেষে সকলের একটিই চাওয়া স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরুক পৃথিবী, নতুন করে হাসুক সকাল।