আবরার হত্যায় ভয় পেয়ে প্রথমে বুয়েটে ভর্তি হতে চায়নি রাসেল
২০১৯ সালের মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তিযুদ্ধ শেষ হলো। অনেক অভিভাবককে সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা গেছে। অনেকে সন্তানকে নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছুটে চলেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কিন্তু ভাগ্য সবার সহায় হয়নি। অধরা রয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সেই সোনার হরিণটি।
এখন একজন শিক্ষার্থীর কথা বলব, যাঁর জীবনের গল্প রূপকথার গল্পকে হার মানায়। অনেক শিক্ষার্থী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতে কষ্ট করতে হয়, সেখানে বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন ছেলেটি।
ছেলেটি মো. আবু রাসেল। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সিরাজপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। বাবা আতিয়ার রহমান ও মা খায়রুন্নেসার একমাত্র ছেলে তিনি। আছে এক বোন। গত বছরে অক্টোবরে আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা মনে করে বুয়েটে ভর্তি না হয়ে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে।
পরে অনেকেই তাঁকে বুঝিয়েছেন, বুয়েটে পড়ার সৌভাগ্য সবার হয় না, আর বুয়েট এখন রাজনীতিমুক্ত। সুতরাং এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। তখন কষ্ট করে ধারদেনা করে আবার ভর্তি হয়েছেন বুয়েটের আরবান রিজওনাল প্ল্যানিং বিভাগে।
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছেন বাবা মানসিক অসুস্থ। মা অনেক কষ্টে সংসারটি আগলে রেখেছেন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল বন্ধ করে জরি–পুঁথির কাজও করেছেন ভাইবোন। এতে সংসারে একটু অর্থ জোগান হতো। তাই লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগ দিতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণিতে যখন জিপিএ–৫ পেলেন। তখন ভাবলেন আমি তো ভালো ছাত্র, একটু মনোযোগ দিয়ে লেখা পড়া করি।
বোনের বিয়ে হয়ে গেল। সংসারে মা-বাবা আর রাসেল। মা ছেলেকে পড়াশোনায় উৎসাহ দিয়েছেন। মেধা ও আর্থিক অবস্থা দেখে ভুরুলিয়া সিরাজপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষক সম্রাট কুমার রাজ বেশি করে যত্ন নিয়ছেন এবং ফ্রি প্রাইভেট পড়িয়েছেন।
জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পাওয়ার পরও অর্থাভাবে পড়ালেখা বন্ধ হতে বসেছিল। এসএসসি পরীক্ষার পর পড়ালেখা বন্ধ করে ঢাকায় চাচাতো ভাইয়ের কাছে যান। কারণ, একটি কাজ জুগিয়ে মানসিক অসুস্থ বাবা ও দিনমজুর মাকে সহযোগিতা করার আশায়। চাচাতো ভাই তাঁর মেধা দেখে কোনোমতেই কাজ করতে দিলেন না। অনেক বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠালেন।
এসএসসি পরীক্ষায় দেখা গেল জিপিএ–৫ পেয়েছেন। আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় ভালো কলেজে ভর্তি হতে চেয়েও পারেননি। কলেজবৃত্তির জন্য আবেদন করেছিলেন চারটি ব্যাংকে। কিন্তু গোল্ডেন এ প্লাস না পাওয়ায় কোনো ব্যাংক থেকে বৃত্তি পাননি। ভর্তি হলেন নিজ গ্রামের ভুরুলিয়া সিরাজপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছিল না বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর জন্য সব সুযোগ–সুবিধা।
কলেজে বিজ্ঞান শাখায় আবু রাসেলের ব্যাচে ১১ জন শিক্ষার্থী। আবু রাসেল ৯ জন সহপাঠীকে প্রাইভেট পড়িয়েছে। বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলত। টিউশনির অর্থ দিয়ে মা–বাবার চিকিৎসা এবং মায়ের একটি অপারেশনও করিয়েছেন। ছয় মাস ক্লাস করে রাসেল আর নিয়মিত কলেজে যেত না।
বাড়িতে নিজে নিজে পড়ে কলেজে পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফল হওয়ায় কলেজে না গেলেও শিক্ষকেরা কিছু বলতেন না। গণিতে একজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তেন। কিন্তু কয়েক মাস পড়ার পর অর্থের অভাবে আর পড়া হয়নি।
তবে বিনা টাকায় পদার্থবিজ্ঞান প্রাইভেট পড়িয়েছেন নকিপুর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বিএসসি শিক্ষক রাজেশ পাল, ইংরেজি পড়িয়েছেন শ্যামনগর দরগাপুর এনডিএস ফাজিল মাদ্রাসার কলেজ শাখার ইংরেজি শিক্ষক এবং জীববিজ্ঞান পড়িয়েছেন ভুরুলিয়া সিরাজপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক নাজমুল হাসান। স্কুল ও কলেজের শিক্ষকেরা তাঁর কাছ থেকে কোনো বেতন বা পরীক্ষার ফি নিতেন না।
এইচএসসি পরীক্ষার পরে ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে বৃত্তির জন্য পরীক্ষা দেন আবু রাসেল। খুলনা বিভাগ থেকে মাত্র দুজন বৃত্তি পান। তাঁদের একজন আবু রাসেল। সারা দেশে ঘুড্ডি ফাউন্ডেশন ২৮ জনকে বৃত্তি দিয়েছে। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোচিং, চার মাস থাকা–খাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফর্মের খরচ ও পরীক্ষা দিতে আসা-যাওয়ার খরচ পেয়েছে।
সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী আবু রাসেল স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে প্রকৌশলী হবেন। এ জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন বুয়েট, কুয়েট ও চুয়েটে এবং পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগরে।
একটি থাকার ঘর ছাড়া জায়গা–জমি বলতে কিছু নেই আবু রাসেলদের। থাকার ঘরটিও আবু রাসেলের এক মামা তৈরি করে দিয়েছেন। আবু রাসেলের মায়ের চিন্তা ছিল কীভাবে সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি করবেন এবং কে পড়ালেখার খরচ চালাবেন?
নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখে জীবনসংগ্রামে হার না–মানা রাসেল আজ বুয়েটের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকাও তাঁর পরিবার দিতে পারেনি। প্রতিবেশী এক চাচা ও তিন শিক্ষকের কাছ থেকে ধার করে বুয়েটে ভর্তি হয়েছেন। একজন শিক্ষক দিয়েছেন আসা-যাওয়ার খরচ। এর আগে কুয়েটে ভর্তির সময়ও কলেজের অধ্যক্ষ কয়েকজনকে বলে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আবু রাসেল চান মানুষের এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের কথা। তিনি গ্রামের বাজারের অনেকের কাছ থেকে তোলা টাকায় ভর্তি হয়েছিলেন ক্যাডেট কলেজে। অদম্য আবু রাসেলও একদিন দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন, এই আশা। (সংগৃহীত)
লেখক: বেসরকারি সংস্থা ভাব-বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার