১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:২৭

বহিষ্কৃত অলির হুমকির পেছনে বাবা হারানোর হৃদয় বিদারক কাহিনী

  © ফাইল ফটো

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) অর্থনীতি বিভাগের সভাপতিকে ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে বহিষ্কৃত অলিকে  নিয়ে স্যোসাল মিডিয়াসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ-হতাশার ঝড় উঠেছে। অলি আবেগবশত এমন অনৈতিক কাজ করেছে দাবি করে তার শাস্তি হ্রাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে অনুরোধও করেছেন শিক্ষার্থীরা।

মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. নূরউদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে অফিস আদেশ (বশেমুরবিপ্রবি/র/একা/৪১/১৩৪৪/(১৫)-এ ইলেকট্রনিকস এন্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইটিই) বিভাগের এমএসসির ছাত্র এস এম অলি উল্লাহকে  আজীবন  বহিষ্কারাদেশ  নিশ্চিত করা হয়। তার শিক্ষাবর্ষ- ২০১২-১৩ এবং পরিচিতি নম্বর ২০১২১২০২০৫৮। 

আজীবন বহিষ্কারাদেশ প্রকাশিত হওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়াসহ চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। পিতৃহীন সন্তানকে আজীবন বহিষ্কারাদেশ মানবিক দিকের কথা ভেবে পুন:বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন তারা। এছাড়া স্বল্পমেয়াদে শাস্তি প্রদানের আহবান করেছেন শিক্ষার্থীরা।

ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলমের লোমহর্ষক বিবৃতিতে উঠে আসে এমন অনৈতিক হুমকি দেওয়ার নেপথ্যে হৃদয় বিদারক কাহিনি। জাহাঙ্গীর আলম প্রথমেই অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক খসরুল আলমের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, ‘প্রথমত সমস্ত শিক্ষক সমাজের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। একজন ভালো মনের শিক্ষকের (খসরুল আলম) সাথে যা হয়েছে সেটা কখনোই কাম্য নয়।

কিন্তু স্যার কিছু কথা থেকেই যায়। আজ আপনারা আপনাদের সন্তানের বহিষ্কারের জন্য মানববন্ধন করেছেন। আমরা ছোটবেলা থেকেই মা-বাবার কাছ হতে শিখেছি মা-বাবার পরেই শিক্ষকের স্থান। আমরা ও সেই আদর্শ নিয়েই বড় হয়েছি এবং এখনো সেই আদর্শের উপরই আছি। আমরা এটাও বিশ্বাস করি শিক্ষকরাও মাতা -পিতার মতো। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মা-বাবা শত ভুল থাকা শর্তেও সন্তানের বিচারের জন্য রাস্তায় নামেনি। তাহলে কি আমরাই ভুল বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছি? 

স্যার, যে ছেলেটা ২০১২ সালে বাবা হারিয়েছে। সে জানে বাবা হারানোর ব্যাথাটা কেমন। তাই হয়তো রুমমেটের (আশিক, তৃতীয় বর্ষ, অর্থনীতি বিভাগ) বাবার মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুতে আবেগ ধরে রাখতে পারেনি।

তারপরেও অবশ্যই যা করেছে সেটা অনেক বড় ভুল। আপনার কাছে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার জন্য গিয়েছে। আপনি ছিলেন না। আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে অনেক টেক্সট করেছে। প্রয়োজনে তার এই ভুলের জন্য সে বারবার ক্ষমা চাইবে। আপনারাই তো স্যার,  আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন ক্ষমা মহৎ ধর্ম। মানুষ তার ভুলের জন্য মন থেকে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে কি তাকে সন্তান হিসেবে ক্ষমা করে একটা সুযোগ দেয়া যায় কি স্যার?

স্যার, আপনার সাথে দেখা হলে প্রয়োজনে ওই ছেলেসহ আমরা আপনার পায়ে ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করবো যেনো তাকে একটা সুযোগ দেন স্যার। একজন সন্তানের জীবন এইভাবে শেষ করবেন না স্যার প্লিজ।

আর স্যার, আপনারাই হয়তো জানেন,  আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে কিন্তু শিক্ষকদের সাথে জোর গলায় কথা বলার সাহস আপনাদের সহপাঠী শিক্ষকরাই দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের দিয়ে কৌশলে আন্দোলন করিয়ে বাধ্য করেছে অন্যদের বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে। অনেকের ব্যাক্তিগত ক্ষোভ মেটানোর জন্য নোংরাভাবে ব্যবহার করেছে শিক্ষার্থীদের। কিছু শিক্ষক উস্কানি দিয়ে  শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে  আপনাদের সহপাঠীদের কৌশলে লাঞ্চিত করেছে। যেই প্রভাব এসে পড়েছে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে।

স্যার, আপনার কাছে আবারো অনুরোধ করবো আপনি আপনার সন্তান ভেবে একটি বার তাকে একটু সুযোগ দিবেন স্যার দয়া করে।’

নাজমা সুলতানা নামে এক ছাত্রী উল্লেখ করেন, ‘ছোট ভাইয়ের বাবা মারা গেছে। যেখানে তার বন্ধুরা আর তার বড় ভাইয়েরা দেখতে যাবে, যার জন্য বাস চাইলো। সে সময় না বললো। তখন হয়তো রাগের মাথায় কিছু বাজে কথা বলে ফেলেছে। সেটা কোন পরিপ্রক্ষিতে এটা শিক্ষকদের কি বোঝা উচিত না?

অন্য কত কাজে বাস দিতে পারে। যেখানে নিজ ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টের বাবা মারা গেলো, সেখানে বাস না চাওয়াটা বা রাজি না হওয়াটা একটা শিক্ষকের জন্য যুক্তিগত? যে ছেলেটার বাবা মারা গেল, সে পাগল প্রায়, অথচ শিক্ষিত শিক্ষক কি তার খোঁজ নিয়েছে? একটু শুনে দেখবেন ভাই। আর কিছু মানুষ নামের জানোয়ার, চাটুকার, তেলবাজ আছে। যারা এই শিক্ষকদের ইন্ধন যুগিয়েছে।

রহমান আতিক নামে এক ছাত্র মন্তব্য করেন, ‘ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার দিতে পারতো। তবুও চিরস্থায়ী বহিষ্কার বিষয়টি বেমানান। একটা পরিবার ধ্বংস করে দিলো প্রশাসন।’

বহিষ্কারাদেশ প্রকাশিত হলে তাবাসসুম মারিয়া নামে এক শিক্ষার্থী প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এভাবে, ‘ইটিই ডিপার্টমেন্টের ওলিউল্লাহকে আজীবন বহিঃষ্কার করা হয়েছে। আমার কিছু প্রশ্ন থেকে যায়- বহিষ্কার কি একমাত্র শাস্তির ব্যবস্থা? কতটুকু তদন্ত করে বহিষ্কার করা হয়? যাদের বহিষ্কার করা হয় তাদের কি কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়?’

মিনহাজুল ইসলাম আকাশ বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী অলির অনুশোচনামূলক কথোপকথন বিবৃতি করেন, ওলি ভাই একটা কথা বলেছেন, ‘বাবা হারানোর কষ্ট উনারা কি বুঝবেন?’ 

অলির কথাগুলো শুনে আকাশ আবেগে আপ্লূত হয়ে বলেন, ‘সাত বছর আগে তার বাবা মারা গিয়েছেন। তার রুমমেটেরও বাবা মারা গিয়েছে কিছুদিন আগে। একটা অনাকাঙিক্ষত ঘটনার জন্য সে নিজেও ক্ষমা চেয়েছেন। আপনারা (প্রশাসন) বাসও দিলেন, আবার তাকে বহিষ্কারও করলেন। এটা কেমন বিচার। ধিক্কার জানাই আপনাদের এমন সিদ্ধান্তকে।

এদিকে মানববন্ধনে বশেমুরবিপ্রবির হাজার শিক্ষার্থীদেরকে কটাক্ষও করলেন। এগিয়ে যান আপনারা। নিন্দা রইলো আপনাদের প্রতি।’

আব্দুল বারি সজীব এ বহিষ্কারাদেশকে ভালোভাবে নিতে পারেন।  তিনি জানান, ‘ধিক্কার  জানাই সেই সব শিক্ষককে। যাদের মধ্যে মানবতার কোন স্থান নাই। বাবা হারানোর বেদনা কি বোঝেন না? সুশিক্ষিত  কি হতে পেরেছেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর কাজ  আসলেই বহিষ্কার করা। বহিষ্কার করার মধ্যেই  প্রকৃত শিক্ষক হওয়া যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

যেখানে বহিস্কার থেকে মুক্তির দাবিতে পুরো দেশকে চিনিয়ে দিয়েছিলাম আমরা সবাই অন্যায় প্রতিবাদ করতে জানি। আজ বাবার লাশ দেখতে গাড়ির চাওয়ার দাবিতে পাশে দাঁড়ায় যারা। তাদেরও নাকি বহিষ্কৃত হয়। এই শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। যদি সুযোগ থাকতো, আজই এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতাম।’

এদিকে অন্য আরেক শিক্ষার্থী জি এম রাশেদের ভাষ্যমতে, ‘শিক্ষককে প্রাণনাশের হুমকি এটা ভুল নয়, অনেক বড় অন্যায়। তবে মানবিক দিক বিবেচনায় আমার মনে হয়, আজীবন বহিষ্কার অনেক বেশি হয়ে গেছে। বিষয়টি পুনরায় বিবেচনায় আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি উদ্দাত্ত আহবান জানাচ্ছি।’

উল্লেখ্য, অলির বহিষ্কারের জন্য গত মঙ্গলবার দুপুরে মানববন্ধনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা তার আজীবন বহিষ্কারাদেশের খবরে হতাশা প্রকাশ করেছেন। মানবিক দিক বিবেচনা করে শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার এবং সাময়িক শাস্তি প্রদান করে তার শিক্ষাজীবন সচল রাখতে প্রশাসনের কাছে অনুরোধও করেছেন শিক্ষার্থীরা।