আবরার হত্যা: শত মায়ের স্বপ্নভঙ্গ!

মা তার সন্তানকে দেখছেন
মা তার সন্তানকে দেখছেন   © ফাইল ফটো

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাতে আরেক মেধাবীর এমন মৃত্যু মেনে নিতে পরেনি কেউ। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত ২৬ শিক্ষার্থীকে তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

এসব শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ফলে তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ার স্বপ্ন হয়েছে ভঙ্গ। শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে শেষ হয়ে গেছে শত মায়ের স্বপ্নও। এতগুলো শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের স্বপ্ন-মর্যাদা ধূসর হয়ে গেছে। কী হবে তাদের শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের? তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

আবরার হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিলের পর হত্যার সাথে জড়িত ২৬ জনকে স্থায়ীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে র‌্যাগিংয়ে জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী ও আহসানউল্লাহ হলের ৩৩ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে প্রশাসন। এদের মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিভিন্ন মেয়াদে এবং হল থেকে আজীবন বহিষ্কার হয়েছেন- এমন শিক্ষার্থী ৩৬ জন। বাকিদের সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে। সেই ধারাবহিকতা বজায় আছে এখনো।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার র‌্যাগিংয়ে জড়িত থাকার দায়ে বুয়েটের তিতুমীর হলের আট শিক্ষার্থীকে হল থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। আরও ছয় শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া এক ছাত্রকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করা হয়েছে। দিন দিন র‌্যাগিংয়ে জড়িত হওয়ার ঘটনার সাথে সাথে বাড়ছে বহিষ্কার হওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও। সর্বশেষ পরিসংখ্যান সে দিকেই ইঙ্গিত দেয়।

আবরারকে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে হওয়া চুক্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে। স্ট্যাটাস দেয়ার কারণ জানতে ৬ অক্টোবর রাত আটটার দিকে আবরারকে শেরে বাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যে রুমে নিয়ে যাওয়া হয় পরবর্তীতে তদন্ত করে সেটি হলের টর্চার সেল হিসেবে সামনে আসে।

রাত ২টা পর্যন্ত চালানো হয় নির্যাতন। ঢাকা মেডিকেলের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের ভাষ্যমতে আবরারকে সে রাতে রড, স্ট্যাম্প এবং বাঁশের মতো ফাঁপা জাতীয় জিনিস দিয়ে পেটানো হয়। হত্যার ঘটনায় জড়িতদের জবানবন্দীতে বেরিয়ে আসে আরো অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা। সে রাতে ছাত্রলীগ নামধারীদের কয়েকজন মদ্যপ অবস্থায় উন্মাদ হয়ে পেটাতে থাকে আবরারকে।

আবরারের দেহ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে যখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে তখন তারা তাকে শেরে বাংলা হলের এক তলা এবং দ্বিতীয় তলার মাঝামাঝি যে ফাঁকা যায়গা সেখানে ফেলে রেখে চলে যায়। রুম থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া শুরু করে পুরো ঘটনার চিত্র সিসিটিভি ক্যামেরায় বন্দী হতে থাকে। সেই সিসিটিভি নিয়েও চলে নানা তাল-বাহানা। শিক্ষার্থীদের অব্যহত চাপের মুখে সেই ফুটেজ সাধারণ মানুষের সম্মুখে আসে।

টর্চাল সেলের নির্মম নির্যাতনের চিত্র গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই চিত্র দেখে অনেকেই নীরবে কেঁদেছেন। জানিয়েছেন ধিক্কার। দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয়েছে মানববন্ধন। আবরারকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার মুহূর্তের মধ্যে তার সেই স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়ে যায়। কি ছিল সেই স্ট্যাটাসে?

মেধাবী আবারার শুরু থেকেই ছিলেন মুক্তমনা। যেকোন বিষয়ে তিনি লিখতেন। তার লেখার অন্যরকম এক শক্তি ছিল। তাই অনেক আগে থেকেই বুয়েট ছাত্রলীগের নজরে আসেন তিনি। তার সর্বশেষ স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, “৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশেে কোন সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।

কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।

কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।

হয়তো এসুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন-
“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”

এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমেই শেষ হয়ে যায় আবরার অধ্যায়। আবরার হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত যেসব শিক্ষার্থীকে বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে, তাঁরা হলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না, আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা, উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ, সহসম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, সাবেক সহসভাপতি এস এম মাহমুদ সেতু এবং সদস্য ও কর্মী মিজানুর রহমান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মুনতাসির আল জেমি, মুজাহিদুর রহমান, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, এহতেশামুল রাব্বি তানিম, শামীম বিল্লাহ, মাজেদুর রহমান, আকাশ হোসেন, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান জিসান, মোয়াজ আবু হোরায়রা, এ এস এম নাজমুস সাদাত ও মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম৷ এঁদের মধ্যে আশিকুল ইসলাম বিটু ছাড়া বাকি সবার নাম পুলিশের অভিযোগপত্রে রয়েছে৷

বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত ছয়জন হলেন বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ছাত্র আবু নওশাদ সাকিব, সাইফুল ইসলাম, মোহাম্মদ গালিব, মো. শাওন মিয়া, সাখাওয়াত ইকবাল অভি ও মো. ইসমাইল৷ আবরার হত্যার ঘটনায় বিভিন্ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট থাকাসহ কয়েকটি অভিযোগে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়েছে৷

তিতুমীর হলের আজীবন বহিষ্কার ও একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছেন মো. তানভীর হাসনাইন, মির্জা মোহাম্মদ গালিব, মো. জাহিদুল ইসলাম, মো. মুস্তাসিন মঈন, আসিফ মাহমুদ, মুনতাসির আহমেদ খান, মহিবুল্লাহ হক, আনফালুর রহমান।

বিভিন্ন মেয়াদে আবাসিক হল থেকে বহিষ্কার ও ভবিষ্যতের জন্য যেসব ছাত্রকে সতর্ক করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছে মো. জাহিদুল ইসলাম, জিহাদুর রহমান, মো. এহসানুল সাদ, আবিদ–উল কামাল, মোহাম্মদ সায়াদ ও মাহমাদুল হাসান। তিতুমীর হলের ছাত্র মো. হাসিবুল ইসলামকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করা হয়েছে।

বুয়েটের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে শুধু আবরার কিংবা তার পরিবারেই নয় বরং এর সাথে শেষ হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত বহিষ্কার হওয়া অর্ধশতাধিক মেধাবীর জীবনও। শেষ হয়ে গেছে তাদের পরিবারের স্বপ্নগুলোও। দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে ভর্তি হয়েও এমন নির্মম পরিণতি শুধু আবরারের পরিবারকে নয় ভোগাচ্ছে দোষীদের পরিবারগুলোকেও। পিতা-মাতার স্বপ্নকে আলোকিত করতে আসা এসব মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত জ্ঞানের পরশ না পেয়ে পথ হারিয়েছেন রাজনীতির অন্ধ গলিতে। যেখান থেকে নিস্তার মেলা ভার।


সর্বশেষ সংবাদ