২২ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:২১

আবরারের জন্য আবেগঘন ১০ খোলা চিঠি

  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যার পর তাকে স্মরণ করে অনেকে চিঠি লিখেছেন। তারমধ্যে ১০টি চিঠি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল।

চিঠি_১:

তোমাকে চিনতাম না, তোমার মৃত্যুর মাধ্যমে তোমাকে চেনা লাগলো ব্যাপারটা ভাবতেও খারাপ লাগে। কিন্তু তোমার জন্য আমরা এমন বুয়েট পেলাম, যেই আদর্শ বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমরা সবাই কৃতজ্ঞ তোমার প্রতি। You will be remembered as the hero who sacrificed his life to give us our ‘Land of Living.’

চিঠি_২: 

৬ মাস হয়েছে ক্যাম্পাসে এসেছি ভাইয়া। আপনাকে কখনো দেখি নাই, একই ভবনে ক্লাস করতাম কিন্তু আমরা!

আপনি-আমি মোটামুটি একই স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম এই ক্যাম্পাসে, আপনি সেটা দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু আমি এখন প্রায় সেটা দেখতে পাচ্ছি, কার কল্যাণে জানেন? আপনার! আপনার প্রাণের কল্যাণে!! ক্ষমা করে দিয়েন ভাইয়া, আপনার কষ্টগুলো কখনো লাঘব করতে পারিনি আমরা। ওপার থেকে আমাদের নিশ্চয়ই দেখছেন, আর বলছেন, এতদিনে তোরা করতে পারলি বুয়েটকে Land of Living!

অনন্ত মহাকালে, অসীম মহাকাশের অন্তে আপনি ভালো থাকবেন ভাইয়া। এই বুয়েট আপনাকে কখনো ভুলবে না । Abrar Fahad is BUET!

চিঠি_৩:

আবরার,
তোকে তো অতো ভালো চিনতাম না কখনো, তাই গল্পটা বলা হয়নি, আজ বলি। মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে তোকে, ফার্স্ট ইয়ারের দিকের ঘটনা, পলিটিক্যালদের বিরুদ্ধে সাহস দেখায়ে কিছু বলার জন্য প্রচন্ড মার খেয়েছিলাম। তারপর দুই বছর প্রচন্ড কাপুরুষের মতো বেঁচে ছিলাম। সেদিন সকালে, আরে ঐতো সেদিন সকালে যেদিন তোকে আমরা বাঁচাতে পারিনি, সেদিনের ঘটনা।

বাসায় পড়ে আছি, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, আম্মা সবকিছু দেখতেছে দেশের। আম্মাকে বললাম, আম্মা ক্যাম্পাসে যাইতে হবে। উনি বললেন, না বাপ কয়দিন দেখে যা, কি অবস্থা বলাতো যায় না। উনাকে বললাম, আড়াই বছর ধরে ভেতরটা মরে ছিলো, তোমার আরেক সন্তান মরে গিয়ে ভিতরে একটা যুদ্ধ ঘোষনা করে দিয়েছে। অনেকদিন তো কাপুরুষের মতো ছিলাম মা, এখন একটু বাঁচতে শিখি।

হ্যাঁ আবরার, শোন তোকে বাঁচাতে পারিনি! কিন্ত তারপরও তুই বেঁচে থাকবি এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি জেগে উঠা হৃদয়ে। আমি জানি, তুই সব শুনছিস, এতো মানুষকে জাগিয়ে দেয়া এক আবরার কখনো ঘুমিয়ে থাকতে পারে না, কি বলিস?

ইতি,
তুই নিজে মরে গিয়ে যাদেরকে বাঁচতে শিখিয়েছিস, আমরা, আমরা সবাই!

চিঠি_৪: 

Toke ekhono khuji oi rater taray. vhai tui ki dekshis desh er manus kivabe toke valobasteche. BUET er prottekti dhuli konao tr valobasay sikto. vhai osim akashe ki ekhno oviman kore boshe asis keu tr khoj ney na ei vebe! vhai tr moto ujjol kore futte thaka tara ke keu kokhono vulbe na..

Janis ekhon na campus tay toke onek miss kori. ekhon kotha bolte pari shadin vabe tr jonno. ei je ei ekta shadhin campus upohar diye oviman kore upore boshe asis ! suntesis amra kivabe adharer mayay toke alingon korechi! aj theke tui amar osim mohakasher vhai! ovimani vhai ! kanna cole astese re! tui valo thakis vhai! jekhanei asis vhai amra toke vulte dibo na !

চিঠি_৫:

আবরার ভাই,

আজকের বুয়েটের পিছনে আপনার যে অবদান তা কখনোই শোধ করা সম্ভব না। শুধু এটুকু বলতে পারি, আপনার রক্তের প্রতিটি বিন্দুর কথা মনে রাখবে এই বুয়েট। ওপারে ভালো থাকবেন।
ইতি,
আপনারই এক ছোট বোন

#চিঠি_৬
তোর সাথে ফার্স্ট মিটআপ শেরেবাংলার লাইব্রেরি রুমে, যেখানে তোরা ফার্স্টে ছিলি। একঝাক সতেজ প্রাণ একসাথে। আমার খুব ভাল লেগেছিল ওই রুমটা। এরপরেও দুই একবার গেলাম, তবে কখনো ইন্টারেকশন হয় নাই খুব। এজন্য স্মৃতিও ঝাপসা। এরপর দেখা হলে হাই-হ্যালো ছাড়া কখনো কিছু হয়নাই। সেদিন যখন সকালে ঘটনাটা প্রথমে শুনলাম, লাফ দিয়ে উঠে গেছিলাম ঘুম থেকে।

বিশ্বাসই হচ্ছিল না, ইভেন এখনো মাঝে মাঝে হয় না। সেদিন শেরেবাংলা হলে গিয়ে প্রথম চোখে এসেছিলো গেস্ট রুমের পাশে লেখা গানের ৪ লাইন। কি অবিশ্বাস্য মিল লাইন গুলোর। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, তুই আসলে মারা যাসনি। তুই বুয়েটের একজন শহীদ। তোর রক্তের বিনিময়ে বুয়েট আজ স্বাধীন। এতদিন যা অসম্ভব ছিল, এখন তা বাস্তবায়িত। অনেকেই বলত, বুয়েটের এসব প্রথা ভাঙা যাবেনা। আমি জানতাম না যে ভাঙা যায়, কিন্তু চড়া মূল্যে। আর সেই মূল্য তোকেই পোষাতে হল। ওপারে ভাল থাকিস ভাই। আর বুয়েটের গার্ডিয়ান স্পিরিট হিসাবে থাকিস।

চিঠি_৭:

প্রিয় আবরার ,তুমি আমার পাশে বসে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছো সম্ভবত। ভালো করে কখনো তোমাকে খেয়াল করেও দেখিনি। কিন্তু বুঝেছিলাম যেই ছেলেটা পাশে বসেছে, প্রচন্ড ভদ্র সে। মেয়েদের পূর্ণ সম্মান করে। আসলে আমিও তোমার মত আদর্শে বিশ্বাস করি। তাই তাকাই নাই পাশ ফিরে। অথচ তোমার মৃত্যুর খবর শুনে মনে হয়েছে আপন পরিবারের কেউ চলে গিয়েছে। ঘরে বসে থাকতে পারিনি, আমার ভাই মারা গেছে ,কীভাবে ঘরে বসে থাকি?

লজ্জা ভেঙ্গে তাই আন্দোলনে রাস্তায় বসেছি। আমিও তোমার মত জান্নাতে যেতে চাই ভাই। যদি আল্লাহ কবুল করেন, তাহলে হয়তো দেখা হবে। লিখতে লিখতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এই দুনিয়ায় সেই খুনিদের যতই বিচার করি সেটা কখনোই যথেষ্ট হবে না, এই জুলুমের প্রতিদান নিশ্চয়ই আল্লাহ দেবেন শেষ বিচারের দিনে, যেভাবে তোমার ঈমানী মৃত্যুর দুআ আল্লাহ কবুল করেছেন ইন শাআল্লাহ। তুমি এখন অদৃশ্যের জগতে আছো ,আশা করি অনেক অনেক ভালো আছো।

তবে তোমার পরিবারের নিরাপত্তা এই দেশে কেমন হবে জানি না ,তারাও যেন সবর করে সফলভাবে তোমার সাথে দেখা করতে পারেন এই দুআ করি। তোমার মৃত্যুর কষ্ট আমার বুয়েটের ভাইদের অন্তরে কত সাহস এনে দিয়েছে জানো? কখনো জানতাম না কত কষ্ট করে হলের ছেলেরা। তুমি ওদের জন্য যেভাবে মুক্তির উসিলা হয়েছো, সেটা দেখে অনেক বিস্মিত হয়েছি।

আমার আম্মু তোমার জন্য প্রায় প্রতিদিনই কাঁদে ভাই। যে কখনো তোমাকে দেখেনি, সেও তোমার জন্য কতটা কষ্ট অনুভব করছে, অদ্ভুত না ব্যপারটা? তোমার মা তোমাকে গর্ভে ধারণ করে আমাদেরকে অনেক কিছু দিয়েছেন। তুমি তার নাজাতের উপায় হবে একদিন ইনশাআল্লাহ।

চিঠি_৮:

ভাইয়া,
শেষ কিছুদিন ধরে আম্মা আপনাকে নিয়ে যত কান্না করেছে তা আমার জন্যেও করেনাই। আব্বাও খুব অসুস্থ। জানেন ভাইয়া আমি এই অল্প কিছুদিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। সবকিছু নিজে সামলাই, একলা একলা পড়ি, কথা বলার কেউ নেই, কষ্ট পেলে লুকিয়ে রাখি। আপনাকে নিয়ে কত কিছু হচ্ছে চারপাশে, আমি কিচ্ছুতে আসতে পারিনি। খুব অনুশোচনা হচ্ছিল, আন্দোলনে আসতে পারিনি বলে। কিন্তু যখন দেখলাম wall art গুলোতেও আমারটা স্থান পায়নি মন ভেঙ্গে গেল। এখন চিঠিটা লিখতে পেরে এত ভাল লাগছে।

ওইদিন রাতে আপনার খুব কষ্ট হয়েছিল না? আহারে, পৃথিবীতে জাদুকরী জিনিসগুলো সময়মত হয়না। ওইদিন আপনি ঘুমিয়ে থাকতেন, বাসটা মিস হইত, আপনি বুয়েটেই না আসতেন। আফসোস হয় ভাইয়া, হয়তো ক্যাম্পাসে আপনার পাশে দিয়ে অনেকবার হেঁটে গিয়েছি। আপনার পাশে বসে সেমিনার করেছি । তখন আপনাকে চিনলাম না।

দাদুর কান্না দেখে আমি ডুকরে কান্না করেছি। না জানি আপনার কত কষ্ট হচ্ছে এসব দেখে। বিশ্বাস করেন ভাইয়া, আপনি আমার কেউ না হয়েও এখন অনেক কিছু। পর হয়েও পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছেন আপনি। বড় ভাই, দোয়া করি, আপনি ওপাড়ে ভাল থাকবেন। এ পৃথিবী খুব বাজে জায়গা , এখানে বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকা নয় শুধু সময় পার করা। এই জঞ্জাল ভরা মিথ্যায় জর্জরিত জায়গা আপনার মত পবিত্র মানুষের যোগ্য হতে শিখুক আগে।

এখানে শুধু মায়া আছে, কোন জাদু নেই। আপনি বরং স্রষ্টার সাথে ওই সত্যিকারের জাদুকরী জগতেই থাকুন যেখানে আপনাকে কেউ ব্যথা দিবেনা কষ্ট দিবেনা ।

ভালবাসা থাকল ।

চিঠি_৯:

আবরার ভাই আমার,
জানিনা কতটুকু কষ্ট পাচ্ছিলা তখন , যখন তোমার উপর মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালাচ্ছিল ওরা! হয়ত তোমার চোখে মায়ের মুখখানা ভাসছিলো। হয়তো ছোট ভাইয়ের কোন এক তুচ্ছ আবদার না মানার আফসোস হচ্ছিল, হহয়তোবা বাবার মমতার আলিঙ্গনের কথা স্মরণ করছিলে। হয়তো কোন অব্যক্ত ভালবাসাও ছিল কিনা, যা হয়তো জানাবো করে করে হয়তো সেই মানুষটিকে জানাওনি। ভাবছিলে হয়তো সেও কি কষ্ট পাবে আমার নিথর দেহখানা দেখলে(!)

ভাইয়া জানিনা তুমি কেমন ছিলে এই দুইদিনের দুনিয়াতে। তবে এটুকু হলফ করে বলতে পারি, ওপারে তুমি অনেক ভালো থাকবে ইনশাল্লাহ। আল্লাহ নিশ্চয়ই এত মানুষের দোয়া বৃথা যেতে দেবে না। যত কষ্ট পেয়ে তুমি চলে গেছো তার কয়েকশত কোটি গুণ আনন্দ যেন উনি তোমায় দেয়।

নিশ্চয়ই এ দুনিয়ার সাময়িক সুখের থেকে অনন্তকালের সুখ তোমার কাছে বেশী কাম্য ছিল।

তোমাকে আর কেউ না হোক এই বুয়েট আজীবন মনে রাখবে। কেবল স্মৃতি হিসেবে নয়। একজন দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষ হিসেবে তুমি থাকবে অমর।

-তোমার একজন আপু

চিঠি_১০:

আবরার জানিস?

তুই যেমনটা দেখে গিয়েছিলি বুয়েটকে, বুয়েট এখন একদমই আলাদা। এখন বুয়েটে রাজনীতি নাই, র‍্যাগিং নাই, জুলুমকারীদের দাপট নাই। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা যায় এখানে। একটা মুক্তির বাতাস বয়ে যায় পলাশীর এলাকায়। এটাই চেয়েছিলি না?

আচ্ছা শোন না? আমরা এইযে এতকিছু করলাম, কয়েকদিন পর কি আবার সব আগের মত হয়ে যাবে? এক আবরার হয়ে তুই এত কিছু করে গেলি, এরপর থেকে না হয় আমরা সবাই মিলে আবরার হব!

একা একা কোনো আবরারকে তোর কাছে যেতে দিব না, দেখিস! কথা দিলাম। মানুষ হবার সবচাইতে বড় শিক্ষাটা তোর কাছ থেকে পেয়েছি। তোর জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে যেন কিছুটা হলেও কিছু করতে পারি।

তুই আমার একজন ব্যাচমেট, আমি তোকে দেখিনি কোনোদিন। অনন্ত মহাকাশেই না হয় আমাদের দেখা হবে। সেদিন তোকে আবার রিপোর্টের প্রগ্রেস জানাব। দেখি কিছুটা হলেও মানবতার জন্য কিছু করতে পারি কি না। তোর থেকেই শিখছি প্রতিনিয়ত।

কিন্তু...
তোর শুন্যতা পূরণ করব কি দিয়ে? তোর মত ফাহাদ তো আমাদের অনেক দরকার।

ফেসবুক থেকে সংগৃহীত