বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধে যা বলছেন ছাত্রনেতারা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং বুয়েট আইনে সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ, হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করাসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ক্লাস-পরীক্ষা ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন আবরার হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
তবে, আন্দোলন চলাকালীন সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে সাক্ষাত করে ১০ দফা দাবি মেনে নিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। একইসঙ্গে আবরার হত্যার ঘটনায় উদ্ভুদ পরিস্থিতির জন্য ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।গত শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় বুয়েট কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হয়ে এই ঘোষণা দেন তিনি। এ সময় উপাচার্য নিজ ক্ষমতাবলে শিক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম দাবি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন। তার পাশাপাশি শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন তিনি । এরপর থেকে কোনো সংগঠনভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ক্ষমতা দেখালে শৃঙ্খলা পরিষদের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান বুয়েট উপাচার্য।
তবে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পরপরই সমালোচনার ঝড় ওঠেছে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত পোষণ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ বলছেন, সংগঠন ভিত্তিক রাজনীতি নয়। বরং লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। তাদের মতে, আবরার কে যারা হত্যা করেছে তারা সন্ত্রাস। সন্ত্রাস কোনো দলের হতে পারে না। তাদের মতে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। যদি দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হয় তাহলে সন্ত্রাস বিরোধী চক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ আর থাকবে না।
তারা মনে করেন, যারা স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব গ্রাস করতে চায় এটি তাদের একটি নীল নকশা। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। তবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ না করে ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। ছাত্রলীগের ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল হলেও বর্তমান সময়ে সংগঠনের নেতারা দানবীয় শক্তিতে রূপ নিয়েছে। দানবীয় রূপ নেওয়ার দায়ে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা দরকার। তবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ে শুধুমাত্র ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। এর দায় বহন করতে রাজি নয় অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলো।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিসাবে বুয়েটের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে আমি নই। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে স্বাধীনতাবিরোধী যে অপশক্তি চক্রটি রয়েছে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এখন যেভাবে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে সে সুষ্ঠু পরিবেশ আর থাকবে না। দেশবিরোধী চক্রগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারী মনোভাব ফুটে উঠতে পারে। আমি চাই ছাত্র রাজনীতি থাকুক। তবে যদি কোনো অসঙ্গতি থাকে তাহলে সেগুলো আইডেন্টিফাই করে আমাদের সমাধানের পথে এগোতে হবে।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে যারা গ্রাস করতে চায় তাদের নীলনকশা ফসল। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। প্রত্যেকের জায়গায় প্রত্যেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কর্মরত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সঠিক দায়িত্ব পালন করত তাহলে এমন হত্যাকাণ্ড হত না। আমরা একই দৃশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি আবুবকরের বেলায়। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দলকানা রাজনীতির ফসল।
তিনি আরো বলেন, আমরা বারবার বলছি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। আমরা বারবার বলি তাদের লাগাম টেনে ধরার সময় হয়েছে। তাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা আমরা স্বীকার করি। তবে বর্তমানে তারা দানবে রূপ নিয়েছে। এখন সময় হয়েছে তাদের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি (সহ-সভাপতি) নুরুল হক নূর বলেন, এদেশে ছাত্রসমাজের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। আজকে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া কর্মকান্ডের কারণে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠে এসছে। সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয় বরং সন্ত্রাসী ছাত্ররাজনীতি, লেজুরবৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য সকলের দাবি তোলা উচিত। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা তাদের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেছে তারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানায়নি, তারা সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে।
ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কখনো ছাত্রদল কখনো ছাত্রলীগ কখনো বা ছাত্রশিবির প্রচন্ড পরিমাণ সন্ত্রাস দখলদারিত্ব, ছাত্রদের পক্ষে কাজ না করার কারণে সংগঠনের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যারা প্রগতিশীল তারা ছাত্রদের পক্ষে রাজনীতি করি। আবরার হত্যাকাণ্ডের ফলে শিক্ষার্থীরা মনে করছে যে এটি একটি রাজনৈতিক ফলাফল। আমরা বলি এটি রাজনৈতিক নয়, এটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। বুয়েটের যদি সুষ্ঠু পরিবেশ থাকতো তাহলে সেখানে ভিন্নমত প্রকাশের একটি পরিবেশ তৈরি হতো। যারা ভিন্নমত প্রকাশ করতে দিতে চায় না তারাই কিন্ত আবরার কে মেরেছে। এখানে যদি দখলদারিত্বের বিপরীতে একটি রাজনীতি থাকতো তাহলে কিন্তু আবরার কে জীবন দিতে হতো না। এখানে অপরাজনীতি ও ছাত্রদের পক্ষে রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে।