০৯ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:০৬

বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হলে বিচার হয় না

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ৮ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দশকে খুন হয়েছেন চার শিক্ষার্থী। সিলেট শাহজালাল, লিডিং এবং সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে তিন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। বিচার হয়নি একটি হত্যাকাণ্ডেরও।

একবুক স্বপ্ন নিয়ে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান তাপস সরকার। কিন্তু ভর্তির প্রথম বছরেই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর বুক। এই হত্যার পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বিচারপ্রক্রিয়ার তেমন অগ্রগতি নেই। আসামিদের অনেকেই ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসা করেন।

শুধু তাপস সরকার নন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন ছাত্রলীগের ও তিনজন ছাত্রশিবিরের নেতা ছিলেন। বাকি তিনজন সাধারণ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দেওয়া এই সন্তানেরাই ছিলেন তিন পরিবারের আশা-ভরসা।

সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার খুন হওয়ার দিন রাতেই পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ৬০ জনসহ ৬৫ জনকে আসামি করে হাটহাজারী থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করে পুলিশ। পরদিন রাতে হাটহাজারী থানায় হত্যা মামলা করেন তাপসের সহপাঠী হাফিজুল ইসলাম। এতে ৩০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় ছাত্রলীগের সাবেক উপসংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক আশরাফুজ্জামান ওরফে আশাকে এক নম্বর আসামি করা হয়। অন্যদিকে পুলিশের করা মামলায় তাঁকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। ঘটনার পরপরই তিনি পালিয়ে যান।

এ হত্যার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৬ সালের ২ মে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২৯ নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এতে বলা হয়, আশরাফুজ্জামানের ব্যবহার করা পিস্তলের গুলিতেই খুন হন তাপস। এরপর ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হেলাল উদ্দিনের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আশরাফুজ্জামান। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে তিনি অস্থায়ী জামিন পান। এ ছাড়া এ মামলায় বিভিন্ন সময়ে ১৫ জন গ্রেপ্তার হন। আশরাফুজ্জামানসহ এই ১৫ জন জামিনে আছেন। বাকিরা পলাতক। তাপসের ছোট ভাই শ্রাবণ সরকার বলেন, ‘আমাদের পরিবার খুবই দরিদ্র। ভাইকে হারালাম। বিচারও পেলাম না।’

১০ বছরে ৮ হত্যা

গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি ছাত্র হত্যার শিকার হয় ২০১০ সালে। এর মধ্যে ছুরিকাঘাতে নিহত হন হিসাববিদ্যা বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনে রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের মহিউদ্দিন মাসুম এবং ২৮ মার্চ শাটল ট্রেনে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের হারুনুর রশিদ।

এরপর ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুজন এবং ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি একজন ছাত্রশিবির নেতা নিহত হন। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর নিজ বাসায় খুন হন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী।

মহিউদ্দিন মাসুম ও হারুনুর রশিদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তখন ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা জড়িত ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এরপর এ ঘটনার অগ্রগতি হয়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে বিভিন্ন সংঘর্ষ ও হামলায় নিহত হয়েছেন ৫ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন ছাত্রলীগের তিন নেতা-কর্মী। তাঁরা হলেন রুস্তম আলী, আবদুল্লাহ আল হাসান ও নাসরুল্লাহ নাসিম। আর ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ফারুক হোসেন ও শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানী। দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। দুটি মামলার খোঁজ নেয় না নিহত ব্যক্তিদের পরিবার। ফারুক হত্যা মামলার অভিযোগপত্র জমা হলেও বিচার শেষ হয়নি।

২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে গুলিতে নিহত হন হল শাখা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র রুস্তম আলী। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেহেদী হাসান মতিহার থানায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি আশরাফুল আলমসহ চারজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মেহেদী হাসান বলেন, প্রমাণ করতে না পারায় আদালতে মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে।

২০১২ সালের ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সংগঠনের কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাড়ি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার শাব্দী গ্রামে। হাসান হত্যার ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ নোমান মামলা করেন। মামলায় ১৪ জনকে আসামি করা হয়। মামলার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সহসভাপতি আখেরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল হাসানকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু পরে তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। মামলাটির বিচার চলছে।

২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে শিবিরের নেতা-কর্মীরা ছাত্রলীগ কর্মী ফারুককে খুন করে লাশ শাহ মখদুম হলের পেছনের ম্যানহোলে ফেলে রাখে। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম শিবিরের ৩৫ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও অনেক শিবির নেতা-কর্মীসহ ১০৭ জনকে আসামি করে মতিহার থানায় মামলা করেন। ২০১২ সালের ৩০ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। আসামিদের মধ্যে ৬০ জন জামিনে। গত ২৫ জুলাই এই মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়।

২০১০ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে খাবারের টোকেন নিয়ে সংঘর্ষের জের ধরে ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে পিটিয়ে শাহ মখদুম হলের দ্বিতীয়তলা থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। ২৩ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। নাসিম ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। এ ঘটনায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে নাসিমের বন্ধু আজম আলী মামলা করেন। ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁরা সবাই এখন জামিনে। এ মামলাটিরও বিচার চলছে।

২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগ, শিবির ও বিনোদপুরের ব্যবসায়ীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামান নোমানী নিহত হন। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি ইব্রাহিম হোসেনসহ ২৭ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরে আদালত সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেন।

সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোন্দলে তিনটি হত্যার কোনোটিরই বিচার হয়নি। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তদন্ত চলছে, খুনি শনাক্ত হয়নি, এমন ঘটনাও আছে। আর বিচার চলমান একটি হত্যা মামলা আপস নিষ্পত্তির চেষ্টারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ছাত্রলীগের কর্মী সুমন চন্দ্র দাস। সিলেটের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএর শিক্ষার্থী ছিলেন সুমন। ঘটনার পরদিন তাঁর মা প্রতিমা দাস বাদী হয়ে সিলেট মহানগরের জালালাবাদ থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। তাদের শনাক্ত করতে না পারায় এক বছর পর মামলাটি তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করা হয়।

সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিবদমান দুটি পক্ষের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ‘পার্থ-সবুজ গ্রুপ’ ও ‘অঞ্জন-উত্তম গ্রুপ’-এর মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সুমন চন্দ্র দাস। গুলির ঘটনায় তৃতীয় কোনো পক্ষ জড়িত কি না, এ বিষয়টি বের করার চেষ্টায় তদন্ত বিলম্বিত হচ্ছে। সুমনের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের শ্যামারচরে। মামলার বাদী জানান, এ হত্যা মামলার তদন্ত কারা করছে, অগ্রগতি কী—এর কিছুই তিনি জানেন না।

২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর লিডিং ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মী ওমর মিয়াদকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরীকে আসামি করে মামলা হয়। এ ঘটনার পর ছাত্রলীগের কমিটি কেন্দ্র থেকে বিলুপ্ত করা হয়। এরপর থেকে সিলেটে ছাত্রলীগ কমিটিবিহীন অবস্থায় আছে। ওমর মিয়াদ হত্যা মামলাটি বিচারাধীন আছে সিলেট মহানগর বিচারিক হাকিম আদালতে।

সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগের এক পক্ষ কুপিয়ে হত্যা করে বিবিএর চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী হাবিবুর রহমানকে। ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন তিনি। তাঁর ভাই কাজী জাকির হোসেনের করা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলেছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধান আসামি সাগরসহ ১৪ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। আসামিরা ৯ মাস জেল খেটে জামিনে মুক্ত আছেন। এই সুযোগে মামলাটি আপস–নিষ্পত্তি করতে রাজনৈতিকভাবে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে একটি পক্ষ। ৪০ লাখ টাকায় আপস–নিষ্পত্তি করতে সিলেট ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের দুই নেতা হাবিবুরের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

কাজী হাবিবুরের বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার রানীগাছ গ্রামে। মুঠোফোনে বাদী জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁর ছোট ভাই কাজী মাহবুব হোসেন অবশ্য দাবি করেন, ‘আপস প্রস্তাব নিয়ে কেউ আসেনি। এলেও আমরা এতে রাজি হব না।’

জানতে চাইলে সিলেটের সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘হত্যার ঘটনা আপসে নিষ্পত্তি হতে পারে না। এ রকম হলে তখন সরকারপক্ষ মামলা চালাবে।’