যে কারণে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা
উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে গত তিন দিন ধরে উত্তাল গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি)। ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করা উচ্চ শিক্ষার এ প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষকদেরও নানা দাবি দাওয়া। তবে উপাচার্য ছাত্রছাত্রীদের ‘দাবির চেয়েও বেশি’ মেনে নেওয়ার পরও বিক্ষোভ-আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
আন্দোলনরতরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোঃ নাসিরউদ্দিনের স্বেচ্ছাচার মাত্রা ছাড়িয়েছে। সরকার তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ দিলেও তিনি তার মর্যাদা রাখেননি। তার আচরণও শিক্ষকসুলভ নয়। এর আগেও একবার ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। তখনও তিনি সব দাবি মেনে নেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে তা কার্যকর হয়নি।
তারা জানান, বর্তমানেও ভিসি একদিকে দাবি মেনে নেয়ার কথা বলছেন অন্যদিকে তার অনুগতদের দিয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি নিপীড়নমূলক অবস্থান বদলাননি। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের স্বার্থে হয় তাকে পদত্যাগ করতে হবে নয়তো অপসারন করতে হবে। এটিই এখন একমাত্র দাবি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মভূমি গোপালগঞ্জের এ বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম খায়রুল আলম খান। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে তার মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোঃ নাসিরউদ্দিনকে উপাচার্য হিসেবে ৪ বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করে সরকার।
বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব আছেন ড. খোন্দকার মোঃ নাসিরউদ্দিন। দীর্ঘদিন যাবৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে আসীন থেকে নিজস্ব বলয় তৈরি করেন। এমনকি শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে তিনি ‘গুন্ডাবাহিনী’ হিসেবে ব্যবহার করেন। এর ফলে উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননা।
গত সপ্তাহে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জের ধরে ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া নামের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে কর্তৃপক্ষ সাময়িক বহিষ্কার করেছে। জিনিয়া দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিধি। তিনি একটি ইংরেজি দৈনিকেরও প্রতিনিধি। পরে বিষয়টি নিয়ে উপাচার্যকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয় এবং গত বুধবার তার বহিষ্কার প্রত্যাহার করে কর্তৃপক্ষ। তবে ওইদিন রাতে উপাচার্য ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ দেখায় শিক্ষার্থীরা।
বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রনেতা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, আবু তাহের, শেখ তারেক এবং বাবুল সিকদার বাবু ফেসবুক লাইভে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরলে রাত ১০টা থেকে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ১৪টি সমস্যা সমাধানের নিশ্চয়তা প্রদান করে একটি অফিস আদেশ জারি করে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা এর পরেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের উপাচার্যের পদত্যাগই প্রধান ও একমাত্র দাবি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করার পেছনে ৯টি কারণ জানা যায়। যার মধ্যে রয়েছে-
বিএনপি-জামায়াত রাজনীতির সঙ্গে উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতাঃ আন্দোলনকারীদের বক্তব্য অনুযায়ী- বশেমুরবিপ্রবি উপাচার্য ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন বাকৃবিতে থাকাকালীন সময়ে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। এসময় তিনি বাকৃবির বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের দল সোনালী দলের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আন্দোলনকারীদের মতে কোনো বিএনপি-জামায়াতপন্থী ব্যক্তি জাতির জনকের জন্মভূমিতে তার নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে থাকতে পারেনা।
নারী কেলেঙ্কারীঃ আন্দোলনকারীরা জানান উপাচার্যের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। গত বছর আফরিদা খাতুন নামের এক মহিলা দাবি করেন তার সন্তানের বাবা ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। আফরিদার ভাষ্যমতে উপাচার্য তাকে চাকরি প্রদানের আশ্বাস দিয়ে তার সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে। ওই সময় তিনি এও জানান চাকরি প্রদান না করায় তিনি এই সত্যিটি প্রকাশ করেছেন। তবে আফরিদা খাতুন পরেরদিন অভিযোগ তুলে নেন এবং জানান উপাচার্য তাকে চাকরি প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন। আফরিদা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন যদি উপাচার্য নির্দোষই হন তবে কেনো এমন একটা গুরুতর অভিযোগের পরেও আফরিদার বিরুদ্ধে মামলা না করে বরং তাকে চাকরি প্রদান করলেন।
ভর্তি ও নিয়োগ দুর্নীতিঃ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- উপাচার্য নিয়োগ এবং ভর্তিতে দূর্ণীতি করেন। যার উদাহরণ হিসেবে তারা আক্কাস আলীসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের নাম প্রকাশ করেন। শিক্ষার্থীদের মতে এসকল ব্যক্তিরা শিক্ষক হওয়ার যোগ্য না হলেও উপাচার্য অর্থের বিনিময়ে দূর্ণীতির মাধ্যমে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন এবং বিভিন্ন বিভাগে চেয়ারম্যানের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করেছেন। এছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রেও উপাচার্য অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকেন বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের।
প্রকল্প দুর্নীতিঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান "বশেমুরবিপ্রবি অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে" বড় ধরনের দূর্ণীতি হয়েছে। প্রকল্পটি তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এই প্রকল্পের একটি খাতেরও শতভাগ কাজ হয়নি। তাছাড়া কাজ শুরুর পূর্বেই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ এই প্রকল্পের চারটি খাতে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
বাকস্বাধীনতা হরণঃ আন্দোলনকারীদের মতে- বাকস্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই অধিকার পুরোপুরি হরণ করেছে। কথায় কথায় শিক্ষার্থী বহিষ্কার করেন। শোকজ করেন। অভিভাবকদের সঙ্গেও করেন খারাপ আচরণ। উপাচার্যের এই আচরণের ফলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই অপমানিত হয় ও হতাশায় ভোগে এবং ২০১৭ সালে অর্ঘ্য বিশ্বাস নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে।
শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারাঃ আন্দোলনকারীদের মতে বশেমুরবিপ্রবিতে একের পর এক বিভাগ চালু করা হলেও উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ নেই। বেশিরভাগ বিভাগের ক্লাসই অনুষ্ঠিত হয় টিনশেড কিংবা নির্মানাধীন ভবনে। এর পাশাপাশি নেই পর্যাপ্ত ল্যাবরুম ও লাইব্রেরি সুবিধা।
আবাসন সংকটঃ প্রায় পাঁচ বছরেও উপাচার্য একটি হলেরও নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী সকল শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্ধারিত আবাসস্থলে থাকার কথা থাকলেও উপাচার্য তা নিশ্চিত করতে পারেনি। বর্তমানে প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকে।
বৃক্ষরোপনসহ বিভিন্ন খাতের মাধ্যমে অর্থ লোপাটঃ আন্দোলনকারীদের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণায় বছরে মাত্র ১০ লক্ষ টাকা ব্যয় করলেও কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে উদ্ভিদের পেছনে। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ উপাচার্য মূলত বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে অর্থ লোপাট করেন। তাছাড়া উপাচার্য কমনরুম ফি, ছাত্র সংসদ ফি, বাস ভাড়া, হল ভাড়া এবং বিভাগ উন্নয়ন ফি এর মাধ্যমেও একটি বড় অঙ্কের অর্থ লোপাট করেন বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ।
গুন্ডাবাহিনী তৈরিঃ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ উপাচার্য অর্থ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একটা অংশকে তার গুন্ডাবাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেন এবং কেউ তার বিরোধিতা করলেই এই গুন্ডা বাহিনী দ্বারা তাদের হয়রানি করানোর অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে এসব সমস্যা ও অভিযোগের কিছু কিছু বিষয়ের সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। গত বুধবার এ নিয়ে একটি নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই আশ্বাসে ভরসা করতে পারছেন না। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, উপচার্য আগেও এমন বহু আশ্বাস দিয়েছেন কিন্তু তার কোনোটাই বাস্তবায়ন করেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী জানান, ২০১৮ সালের ৪ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর গ্রামবাসীর হামলার পর আমরা ৫ জুলাই আন্দোলন করেছিলাম। সেখানে আমরা এক বছরের মধ্যে শতভাগ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, হামলাকারীদের বিচার করাসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছিলোম। উপাচার্য আমাদের সকল দাবি মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু আজও সেই দাবি পূরণ হয়নি। একই কাজ তিনি করেছিলেন ২০১৬ এর সেমিস্টার ফি কমানোর আন্দোলনেও। বারবার শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছেন, প্রতারণা করেছেন। তাই আমাদের এখন একটাই দাবি- এই উপাচার্যের পদত্যাগ চাই।
এ প্রসঙ্গে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. খোন্দকার মোঃ নাসিরউদ্দিনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিক্ষার্থীদের সব দাবি-অভিযোগ সত্য নয়। আলোচনার ভিত্তিতে বিক্ষোভ প্রশমন এবং আন্দোলন বন্ধ করার লক্ষ্যে আলোচনা চলছে।