০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৩৪

পবিপ্রবিতে একই বছর অনার্স-মাস্টার্স পাশ করা কর্মচারীর অস্বাভাবিক পদোন্নতির অভিযোগ

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়  © সংগৃহীত

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (পবিপ্রবি) এক নারী কর্মচারীর পর্যায়োন্নয়ন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের একাংশের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে পবিপ্রবিতে নিয়োগ ও পর্যায়োন্নয়নে স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির একজন কর্মচারীর জুনিয়র সহকারী থেকে সিনিয়র সহকারী পদে উন্নীত হওয়ায় নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট নারী কর্মচারীর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সময়কাল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যোগদানের তারিখ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন পক্ষ। তাদের অভিযোগ, একই বছরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা, দ্রুত নিয়োগ পাওয়া এবং পরবর্তীতে অস্বাভাবিক গতিতে পর্যায়োন্নয়ন পাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার ব্যাখ্যার দাবি রাখে। কর্মচারীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘অসাধুচক্র’ নিয়োগ ও পর্যায়োন্নয়নের প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করছে। এই চক্রের সাহায্যে রাজনৈতিক পরিচয় কঠোর আওয়ামী লীগ হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গোষ্ঠী ব্যক্তিগত যোগাযোগ ব্যবহার করে প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রাপ্ত নথিতে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট নারী কর্মচারী এসএসসি পাস করেন ২০০৫ সালে, এইচএসসি ২০০৭ সালে, স্নাতক ২০১২ সালে এবং একই সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৮ জুলাই তৎকালীন পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজের সুপারিশে এবং বড় অংকের উৎকোচের বিনিময়ে পবিপ্রবিতে জুনিয়র সহকারী পদে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার স্বামী মো. সাইফুল্লাহও একই কৌশলে স্ত্রীর মাধ্যমে উক্ত আওয়ামী লীগ নেতার সুপারিশে সিনিয়র সহকারী পদে চাকরি নেন। সাইফুল্লাহ ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার ও পবিপ্রবির বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা। যাকে বর্তমান প্রশাসন ৫ আগস্টের ফ্যাসিস্ট পতনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সহকারী রেজিস্ট্রার এবং কেয়ার টেকিং সেকশনের প্রধানের দায়িত্বে পদায়ন করে। যা বিএনপি–জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, অনার্স–মাস্টার্স দুটোই একই বছরে শেষ করা সাধারণত একাডেমিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিষয়টি তদন্ত করা প্রয়োজন। ২০১৮ সালে নিয়োগের পর মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সিনিয়র সহকারী পদে ওঠার ঘটনা অত্যন্ত অস্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী এ ধরনের পদোন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দ্রুত অগ্রগতি প্রমাণসহ ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর স্বামী মো. সাইফুল্লাহ, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু পরিষদের একজন নেতা এবং সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেয়ার টেকিং সেকশনের প্রধানের দায়িত্বে আছেন। শুধু তাই নয়, তিনি তার দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়া ও ক্লিনারদের দিয়ে বাসার কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে বলে বলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী এক শিক্ষক বলেন, তার অনার্সের রেজাল্ট তৃতীয় শ্রেণি হওয়ায় ইমপ্রুভমেন্ট দিয়ে পরবর্তীতে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়েছে, তাই একই বছর দেখায়। তাহলে তো তার মাস্টার্সের রেজাল্ট গ্রহণযোগ্য নয়। মাস্টার্সের ফল নিতে হলে অনার্সের তৃতীয় শ্রেণির ফল ব্যবহার করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তার সেকশন অফিসার পদে পদোন্নতি আরও এক বছর পরে হওয়ার কথা।

তিনি আরও বলেন, পবিপ্রবিতে নিয়োগ ও পদোন্নয়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। তা না হলে ফ্যাসিবাদের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার পরও এই ধরনের ঘটনা অনিয়মের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। একই বছরে অনার্স–মাস্টার্স, অস্বাভাবিক পর্যায়োন্নয়ন এসব প্রশ্নের উত্তর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযুক্ত কর্মচারীর সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি।

অভিযুক্তের স্বামী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেয়ার টেকিং সেকশনের প্রধান মো. সাইফুল্লাহ বলেন, আমি আমার দাপ্তরিক দায়িত্বই পালন করি। কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা বা প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো অসংগতি পেলে আমার স্ত্রীকে চাকরিচ্যুত করতে পারে আমি তা মেনে নেব।

তিনি আরও বলেন, আমি কোনো নিয়োগ বা পদোন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কোনো চক্রকে উৎকোচের বিনিময়ে হস্তক্ষেপ করিনি। এসব অভিযোগ রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থে ছড়ানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগ ও পদোন্নয়ন নীতিমালা স্পষ্ট। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান সেসব লঙ্ঘন করে, তবে তা তদন্তের আওতায় আসে। পবিপ্রবির বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেলে ইউজিসির উচ্চপর্যায়ের টিম নথি পরীক্ষা করবে।

এ বিষয়ে পবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগ–পদোন্নয়ন বিধিমালা অনুযায়ী হয়। তবে কেউ অভিযোগ করলে আমরা তদন্ত করি। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ পেলে তা স্বচ্ছভাবে পর্যালোচনা করা হবে।