কুয়েটে নির্যাতন: শিক্ষার্থীদের শাস্তি হলেও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বিষয়ে অগ্রগতি নেই
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমানকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হাতে নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের শাস্তি নিশ্চিত হলেও সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনো নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযোগ উঠেছে, ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, আর বিচার প্রক্রিয়া আটকে আছে প্রশাসনিক অনীহা ও জটিলতায়।
জাহিদুর রহমানের অভিযোগ অনুসারে, ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন কুয়েট প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ক্যাডাররা ড. এম এ রশিদ হলের ১১৫ নম্বর রুম এবং গেস্ট রুমে সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ১২ পর্যন্ত পালাক্রমে তার ওপর অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে পাইপ, হাতুড়ি, স্টাম্প, প্লায়ার্সের ব্যবহার ছাড়াও তাকে কারেন্টের শক দেওয়া হয়।
তিনি জানান, নির্যাতনের সময় তৎকালীন ড. এম এ রশিদ হলের প্রভোস্ট হামিদুল ইসলাম, ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ড. ইসমাঈল সাইফুল্লাহ এবং সিকিউরিটি ইনচার্জ সাদেক হোসেন প্রামাণিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তারা জাহিদুরকে বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বরং ছাত্রলীগের পক্ষেই অবস্থান নেন।
পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে হল প্রভোস্ট এবং ছাত্রকল্যাণ পরিচালক তাদের ওপর উল্টো জাহিদুরকে গ্রেপ্তার করার জন্য মামলা নিতে চাপ দেন। পুলিশ অস্বীকৃতি জানালে তৎকালীন উপাচার্যের (ভিসি) ড. মিহির রঞ্জন হালদারের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজের প্রিজন সেলে ভর্তি করে দেয়। পরের দিন, ১২ সেপ্টেম্বর, সিকিউরিটি ইনচার্জ সাদেক হোসেন প্রামাণিক বাদী হয়ে জাহিদুরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন, যার সাক্ষী ছিলেন হল প্রভোস্ট হামিদুল ইসলাম ও সহকারী প্রভোস্ট সুনন্দ দাস। এ মামলায় জাহিদুরকে কারাবাস করতে হয় এবং ৫২ দিন পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপরও তৎকালীন প্রশাসন তাকে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধা দেয়।
শিক্ষার্থীদের শাস্তি, শিক্ষক-কর্মকর্তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে
২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জাহিদুর রহমান তৎকালীন ভিসি ড. মুহাম্মাদ মাছুদ প্রশাসনের কাছে তার ওপর হওয়া অন্যায়ের বিচার চেয়ে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করে। ফলস্বরূপ ২০২৫ সালের ২৭ জানুয়ারি ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির সভায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ১৩ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—যার মধ্যে ৪ জনের সার্টিফিকেট বাতিলসহ ১০ জনকে চিরতরে বহিষ্কার করা হয়।
তবে জাহিদুরের মূল অভিযোগ: শিক্ষার্থীদের শাস্তি নিশ্চিত হলেও নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলায় জড়িত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এমনকি তার বিরুদ্ধে মামলা করা সাদেক হোসেন প্রামাণিক এখনো সিকিউরিটি ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করছেন।
আরও পড়ুন: এবারও উৎসব করে নতুন বই দেবে না সরকার: গণশিক্ষা উপদেষ্টা
জাহিদুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। আমার স্বাভাবিক জীবন নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত তৎকালীন প্রশাসনের কারো কোনো বিচার হয়নি। আমার ক্ষতির জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করলেও প্রশাসন এড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বারবার আবেদন করেছি, আইনজীবীর মাধ্যমে চিঠি ও লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি, তবুও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। বর্তমান কুয়েট প্রশাসন স্পষ্টভাবে বিচার নিশ্চিত করতে অসহযোগিতা এবং দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে।’
এ ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অপরাধের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সভাপতি এবং কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমরা অভিযোগের সত্যতা যাচাই করেছি। এই ঘটনায় ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা কার কি ভূমিকা ছিল সেটা উল্লেখ করেছি। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা সকলে মিলে জাহিদুরের উপর নির্মম অত্যাচার করেছে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম এবং মানবিকতার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। এখানে স্পষ্টভাবে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। ভিকটিম তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাখে।’
শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অপরাধ এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুয়েট ইসিই বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. শেখ শরীফুল আলম প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে বলেন, ‘তদন্তে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছিল। কিন্তু ছাত্র-শৃঙ্খলা কমিটির কার্যপরিধি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের বিচার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলস্বরূপ এই কমিটি শিক্ষক-কর্মকর্তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার রাখে না।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট-এর উপর ন্যস্ত। কিন্তু, গত ২৭ জানুয়ারী, ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত ছাত্র-শৃঙ্খলা কমিটির সভার পর তৎকালীন প্রশাসন নিয়মিত কোনো সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করার সুযোগ লাভ করেনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়েট ভিসি প্রফেসর ড. মাকসুদ হেলালি বলেন, ‘প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মের ভেতর থেকে নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীকে যথাযথ সহযোগিতা করার কথা চিন্তা করছে। কিন্তু যেহেতু এটা কোর্টের বিষয়। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অনেক সমস্যা থাকায় পূর্বের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগও কম।’
ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি বলেন, ‘ফান্ড সংগ্রহের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে তাকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’