শীতের সকালের স্নিগ্ধতায় মুখর মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়
শীতের হিমেল বাতাসে চারদিকে নেমেছে সাদা কুয়াশার নরম চাদর। সূর্য তখনও পুরোপুরি ওঠেনি, তবে পূর্ব দিগন্তে হালকা কমলা আভা জানান দিচ্ছে দিনের সূচনা। এমন কুয়াশামাখা ভোরে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি)।
ভোরে ঘুম থেকে উঠেই চোখে পড়ে নানা মানুষের আনাগোনা। কেউ কুয়াশার ভিতর দিয়ে সতেজ বাতাসে হাঁটে বা দৌড়ায়, কেউ ব্যায়ামে ব্যস্ত। আবার কেউ শখের বশে কাক ডাকা ভোরে গ্রামাঞ্চলের খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে, কেউ ছুটে যায় হাটে কেনাকাটার জন্য, আর কেউ গরম চায়ের কাপ হাতে অপেক্ষা করে সূর্যের প্রথম কিরণ দেখার।
এই সময়টিকে সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক বলে মনে করেন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আল শাহরিয়ার ইমন। ভোরে শরীরচর্চা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভোরের স্নিগ্ধ আবহাওয়া আমাদের শরীর, মন এবং আত্মার মানসিক প্রশান্তি দেয়। প্রতিদিন সকালে উঠে ক্যাম্পাসে গিয়ে এই পরিবেশ উপভোগ আর শরীরচর্চা করা এখন যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শরীরচর্চা আমাদের পটেনশিয়ালিটি বৃদ্ধি করে, মনন বিকাশে সাহায্য করে, আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে তোলে, এমনকি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাও তৈরি করে। আরও ভালো লাগে যখন দেখি আমার মতো অনেকেই ভোরে শরীরচর্চার জন্য আসে। তখন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে কিছুটা গল্পও করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তাদেরও ভোরে হাটাহাটি করতে দেখা যায়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম ফটকের আশপাশে এবং স্থানীয় চায়ের দোকানগুলোতে ভোরেই জমে ওঠে ভিড়। শীতের পিঠা ভাপা-চিতুই আর গরম চা উপভোগে শিক্ষার্থীদের মুখে ফুটে ওঠে উচ্ছ্বাস।
ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশনাল সায়েন্স (এফটিএনএস) বিভাগের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান মীম বলেন, 'ভোরবেলার কুয়াশা, গরম চা আর পিঠার স্বাদ—এই পরিবেশটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। পড়াশোনার চাপ থাকলেও শীতের সকালে যেন মনটা একটু বেশি সতেজ থাকে। শীতের সকালে ক্যাম্পাস যেন অন্যরকম রূপ নেয়, সবার ব্যস্ততা, ৯ টার ক্লাস যে সে কি পাথর চিবানো কাজ। সবার গায়ে নানান রকমের কার্ডিগান। যদিও শীত এখনো ক্যাম্পাসের দুয়ারে পুরোপুরি আসে নি। সকাল বেলার হালকা রোদ, হালকা শীত সত্যিই অন্যরকম একটা অনুভূতি।'
সূর্যের প্রথম রশ্মি কুয়াশা ভেদ করে যখন গাছের পাতায় পড়ে, তখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে অনন্য আলোর খেলা। হাতির কবর, বিজয় অঙ্গন, জুয়েল চত্বর, স্টেডিয়াম, হল চত্বর বা তৃতীয় একাডেমিক ভবনের সামনে দেখা যায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সময় কাটাতে। কারও হাতে ক্যামেরা, কেউবা কেবল বন্ধুদের সাথে বসে কুয়াশার মোড়া প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করে।
এসময়ে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরনে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোযুক্ত শীতকালীন পোশাক বা বিভিন্ন রঙের উষ্ণ পোশাক—যা শুধু শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে নয়, ক্যাম্পাস পরিচয়ও তুলে ধরে।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী শেখ সামিউল ইসলাম বলেন, 'শীত যেন ক্যাম্পাস জীবনে আলাদা একটা সৌন্দর্য যোগ করে। কুয়াশার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ক্লাসে যাওয়া, লাইব্রেরি খোলা অপেক্ষা করা—এসব যেন ছাত্রজীবনের বিশেষ স্মৃতি হয়ে যায়।'
বিকেল নামতেই ক্যাম্পাস যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। মাঠে খেলা, স্টেডিয়ামে অনুশীলন, আর সূর্য ডোবার পর সুরের সাগরে ভেসে যাওয়া—গানের আসর যেন শীতের সন্ধ্যাকে আরও উজ্জীবিত করে।
এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (ইএসআরএম) বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আহমেদ শ্রাবণ বলেন, “সন্ধ্যাবেলা গান আর আড্ডা, এটাই আমাদের ক্যাম্পাসের উষ্ণতা। শীত কেবল ঠান্ডা নয়, এটি আমাদের কাছে আনন্দের ঋতু।”
প্রকৃতিরও যেন নতুন রূপ দেখা যায়। গাছের পাতায় শিশিরবিন্দু, অতিথি পাখির ডানায় কুয়াশার ঝাপটা, আর ফুলের উপর সূর্যের ঝিলমিল; সব মিলিয়ে ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে যেন জীবন্ত চিত্রকর্ম। শীতের সকাল যেমন ক্লাসের ব্যস্ততায় পূর্ণ থাকে, তেমনি শিক্ষার্থীদের জন্য এনে দেয় নির্মল প্রশান্তি।
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব আল হাসান বলেন 'প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের মাঝেই আমরা পড়াশোনা করি, স্বপ্ন দেখি, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করি। ক্যাম্পাসের প্রতিটি ঋতুই আমাদের জীবনের অংশ।'
শীত কিংবা গ্রীষ্ম, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল যেন কখনো ঘুমায় না। কারও রুমে রাতভর আড্ডা, কেউ প্রিয়জনের সাথে কথা বলে সময় কাটায়, কেউ চিন্তা-স্বপ্নে জেগে থাকে। আবার কেউ চাকরি বা ভালো ফলাফলের প্রত্যাশায় রাতভর পড়তে থাকে। ভোর হওয়ার আগেই কেউ কেউ নৈমিত্তিক কাজের জন্য উঠে পড়ে। ক্যাম্পাসের রাত থেকে ভোর, প্রতিটি মুহূর্তই হয়ে ওঠে ব্যস্ততা, স্বপ্ন, সংগ্রাম আর ভালোবাসায় ভরা।