৩০ জুলাই ২০২৫, ২০:০১

ভবিষ্যতের শক্তি নিরাপত্তা নিয়ে চুয়েটে আলোর মিছিল

শিক্ষার্থীদের আলোর মিছিল  © টিডিসি

প্রযুক্তির ক্যাম্পাসে আজ সকালটা যেন ভিন্ন আলোয় উদ্ভাসিত ছিল। বেলুনের রঙে রঙিন আকাশ, শিক্ষার্থীদের ছন্দবদ্ধ পদচারণা, আর পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং বিভাগের সামনে থেকে শুরু হওয়া র‌্যালির গন্তব্য যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তন—তখন বোঝা যাচ্ছিল, চুয়েটে আজ কিছু একটা বড়সড় শুরু হচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে দেশের ভাবনা যেখানে দিন দিন গাঢ় হচ্ছে, সেখানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) উদ্যোগে আয়োজন করা হলো দুই দিনব্যাপী ‘জাতীয় সেমিনার অন এনার্জি সিকিউরিটি– ২০২৫’। 

আজ বুধবার (৩০ জুলাই) শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী এ জাতীয় সেমিনার। বিশ্ববিদ্যালয়টির পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং (পিএমই) বিভাগের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ সম্মলনে অংশ নিচ্ছেন দেশের খ্যাতিমান গবেষক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ, শিল্প উদ্যোক্তা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা।

আজ সকাল ১০টায় শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড.মাহমুদ আবদুল মতিন ভূইয়া। এ ছাড়া বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিন উল আহসানসহ আমন্ত্রিত অন্যান্য অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি  পিএমই বিভাগের প্রধান ড. আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। 

অনুষ্ঠানে  আরও উপস্থিত ছিলেন ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্টস ব্লেন্ডারস পিএলসি, পদ্মা অয়েল পিএলসি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড, এলপিজিএল ও যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধিরা।

এরপর জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারক ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় মূল প্রবন্ধ পাঠ  ও টেকনিক্যাল প্রেজেন্টেশন। এতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা, জ্বালানি আমদানি নির্ভরতা হ্রাস এবং ভবিষ্যতের টেকসই জ্বালানি নীতি নিয়ে আলোচনা করেন ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড.মাহমুদ আবদুল মতিন ভূইয়া তার বক্তব্যে বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব জ্বালানি ও শক্তির নিরাপত্তার জন্য দৌড়াচ্ছে। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র পৃথিবীর উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন। এই শক্তি আমরা কেবল জ্বালানি থেকে নয়, বাতাস, সূর্যালোক এবং পরিবেশবান্ধব অন্যান্য উৎস থেকেও পেতে পারি। এই সম্ভাবনাগুলো আমাদের মাথায় রাখতে হবে এবং বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। আজকের এ আয়োজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করবে এবং তারা বাস্তব জীবনে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমি পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং (পিএমই)বিভাগের সম্মানিত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এমন একটি সময়োপযোগী ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য। এ আয়োজনের মাধ্যমে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।’

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিন উল আহসান বলেন, “রিনিউয়েবল এনার্জি অবশ্যই আমাদের ভবিষ্যৎ, তবে বর্তমানে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ট্রানজিশন পিরিয়ড’-এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই সময়টা পাড়ি দিতে আমাদের প্রচলিত জ্বালানি (ফসিল ফুয়েল) ব্যবহারের দিকেই আপাতত নজর দিতে হবে। কারণ আমাদের দেশ এখনও আমদানিনির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল এবং এর একটি বড় অংশ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়। যদি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পিএমই বিভাগের যোগাযোগ আরও দৃঢ় হয়, তবে সরকার ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) থেকে সহযোগিতা পাওয়া আরও সহজ হবে। ল্যাবরেটরিগুলো যদি আরও আধুনিক ও সুসজ্জিত করা যায়, তবে আরও উন্নত রিসার্চ ও টেস্টিং সম্ভব হবে।’

তিনি বলেন, ‘পিএমই বিভাগের শিক্ষার্থীদের জ্বালানি খাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও কূপ খননের কাজ শুরু হচ্ছে। এসব কাজ  বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন বাস্তবমুখী দক্ষতা, কঠোর পরিশ্রম, এবং ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা। একইভাবে শিক্ষকদেরও নিয়মিতভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। রিসার্চ ল্যাবরেটরিগুলোকে আধুনিকায়ন করতে আমাদের সবার (বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠান) যৌথ সহযোগিতা প্রয়োজন।’

পিএমই বিভাগের প্রধান ড. আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম বলেন, ‘আমাদের এই সেমিনারের মূল উদ্দেশ্য হলো পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং খাতে শিল্প-শিক্ষার মধ্যে দৃঢ় সংযোগ স্থাপন করা। জ্বালানি খাতের নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য। আমি আশা করি, এই আয়োজন শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী জ্ঞান ও ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের পথ সুগম করবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএমই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাফিস ইকবাল আশিক বলেন, ‘এই জাতীয় সেমিনারে অংশ নিতে পেরে আমি সত্যিই গর্বিত। পেট্রোলিয়াম ও মাইনিং খাতের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সরাসরি জানতে পারা এবং দেশের শীর্ষ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ আমাদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এ ধরনের আয়োজন আমাদের বাস্তবমুখী জ্ঞান ও ক্যারিয়ার গঠনে দারুণভাবে সহায়তা করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’

দুপুর সাড়ে ১২টায় শুরু হয় প্রথম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন,  প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভূইয়া। তিনি ‘বাংলাদেশের এনার্জি সেক্টরের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশল’ বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন।

মধ্যান্হভোজের বিরতির পর বেলা ৩টায় দ্বিতীয় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) অধ্যাপক ড. এ কে এম বদরুল আলম। তিনি  বক্তব্য দেন বাংলাদেশে কয়লা খনির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে।

পর্যায়ক্রমে আরও একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন ও দুটি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল টক আয়োজিত হয়। সন্ধায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৈশভোজের মাধ্যমে প্রথম দিনের কার্যক্রম  সমাপ্তি হয়।

এ সম্মেলন ছিল দেশি পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের মতবিনিময়ের একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্ম, যা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চুয়েটের পিএমই বিভাগ, যা বাংলাদেশের চারটি স্নাতক পর্যায়ের পেট্রোলিয়াম এবং মাইনিং সম্পর্কিত বিভাগের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত, এই আয়োজনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবমুখী গবেষণার প্রদর্শনী ও নেটওয়ার্কিং সুযোগ তৈরি করেছে। আজকের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে জব ফেয়ার যেখানে তারা শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের কাছে তাদের জীবন বৃত্তান্ত প্রদান করবেন।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে, আগামীকাল ৩১ জুলাই পর্যন্ত চলবে এই সম্মেলন। দেশি জ্বালানি নীতির ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণে এই আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।