বুটেক্সে শিক্ষক-ক্লাসরুম সংকটের মধ্যেই নতুন বিভাগ চালু, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে শিক্ষক এবং ক্লাসরুম সংকট। এরইমধ্যে টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে নতুন বিভাগ চালু করার ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিদ্যামান সমস্যার সমাধান না করেই ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন বিভাগটি চালু করছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ক্লাসরুম ও শিক্ষক সংকটে জর্জরিত বুটেক্সের শিক্ষার্থীরা এটিকে ভুল পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। প্রশাসনের এ ঘোষণার পর বুটেক্স ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন নামক একটি ফেসবুক গ্রুপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরছেন তারা। এ নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তবে নতুন বিভাগ চালুর ঘোষণায় অনেকে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিভিন্ন বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক সংকট রয়েছে। এছাড়া ক্লাসরুম সংকটের কারণে ক্লাস এবং ল্যাব কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে একই ক্লাসরুমে একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে ক্লাস করতে হয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কোর্স সঠিক সময়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা অভিযোগ করেন।
বুটেক্সের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ৫টি অনুষদ ও ১৭টি বিভাগ নিয়ে বুটেক্স আইন-২০১০ অনুমোদিত হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয় ৫টি ডিগ্রি অ্যাওয়ার্ডিং বিভাগ নিয়ে। পরবর্তীতে আরও ৫টি ডিগ্রি অ্যাওয়ার্ডিং বিভাগ যুক্ত করা হয়। তার মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছিল এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে নতুন বিভাগ হিসাবে টেক্সটাইল ম্যাটারিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং এর যাত্রা শুরু হচ্ছে।
ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. সজিব হাসান বলেন, ৪৯তম ব্যাচের প্রায় প্রতিটি বিভাগের শিক্ষক এবং ক্লাসরুম সংকটের কারণে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্লাস করতে হয়। বসার জায়গা না পেয়ে অনেকের দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে হয়। এছাড়া শিক্ষক সংকটের কারণে ল্যাবগুলোও ঠিকমতো হয় না। হলেও দুইটি গ্রুপ একসঙ্গে ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করায় ভালোভাবে শিখতে পারি না। এ অবস্থায় নতুন ডিপার্টমেন্ট চালু করার সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, তা আমাদের জানা নেই। প্রশাসনের উচিত সমস্যার সমাধান করে নতুন পরিকল্পনার দিকে অগ্রসর হওয়া।
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. সাহরিয়ার আলম পাবেল বলেন, বুটেক্সে শিক্ষক সংকট পুরোনো সমস্যা। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের একই ধরনের কিছু কোর্স থাকায় সেগুলো নেওয়ার জন্য প্রচুর শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক কম। তার মধ্যে অনেক শিক্ষক উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। সেজন্য স্বল্প সংখ্যক শিক্ষকের ওপর বেশি চাপ পড়ছে। এ অবস্থায় নতুন বিভাগ খুলে সমস্যা আরও বাড়িয়ে নিজেদেরকে হাসির পাত্র বানানো ছাড়া আর কিছুই করছে না।
টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান হয়েছেন ওয়েট প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মো. মামুন কবীর। তিনি বলেন, বুটেক্সের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ৫টি অনুষদ ও ১৭টি বিভাগ নিয়ে বুটেক্স আইন-২০১০ অনুমোদিত হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু হয় ৫টি ডিগ্রি অ্যাওয়ার্ডিং বিভাগ নিয়ে। পরবর্তীতে আরও ৫টি ডিগ্রি অ্যাওয়ার্ডিং বিভাগ যুক্ত করা হয়। তার মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছিল এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে নতুন বিভাগ হিসাবে টেক্সটাইল ম্যাটারিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং এর যাত্রা শুরু হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ গবেষণা ও নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন বিভাগ যুক্ত করার মাধ্যমে গবেষণার পথ অবারিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই নতুন বিভাগটি যুক্ত করা হয়েছে। এটি চালুর জন্য ২০২২ সালে ইউজিসি থেকে অনুমোদন নেওিয়া হয়। প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দক্ষ নেতৃত্বগুনের অভাবে তৎকালীন উপাচার্য বিভাগটি চালু করতে বিলম্ব করেছেন। কিন্তু বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. জুলহাস উদ্দিনের দক্ষ ও স্মার্ট নেতৃত্বে বিভাগটি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ।
বুটেক্সে শিক্ষক ও ক্লাসরুম সংকটের মধ্যে নতুন বিভাগ চালু করা কতটা যৌক্তিক, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বুটেক্সে শিক্ষক সংকটের অন্যতম কারণ অনেকে ছুটি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়ে আর ফিরছেন না। আবার চাকরি থেকে অব্যাহতিও নিচ্ছেন না। কিন্তু নতুন বিভাগ খোলা হলে ইউজিসি থেকে অনেক শিক্ষক ও অফিসার নিয়োগের অনুমোদন আনা যায়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে যত বিভাগ খোলা হয়েছে, সেগুলোর ল্যাব ফ্যাসিলিটি ছিল না। পরবর্তীতে ল্যাব সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগটির অত্যন্ত উন্নত মানের এবং আধুনিক মেশিনারিজ দ্বারা সমৃদ্ধ ল্যাব রয়েছে।
আরো পড়ুন: কৃষি গুচ্ছের ৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্য ১৯৩ আসনে ভর্তি আজ
এখানে কিছু মেশিন রয়েছে, যা বাংলাদেশের আর কোন ল্যাবে নেই, এ তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, বিভাগটিতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ইউজিসি থেকে অনুমোদন রয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। বিভাগটির ছাত্র সংখ্যা হবে ৪০ জন। তাই নতুন একাডেমিক ভবনের একটি ক্লাসরুম ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ল্যাবটিতে পর্যাপ্ত জায়গা থাকায় খুব সহজেই ক্লাস পরিচালনা করা যাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভাগটিতে যে ধরনের কোর্স কারিকুলাম ডিজাইন করা হয়েছে, তা উন্নতমানের। বিশ্বের যে কোনো উন্নত আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ বিভাগ থেকে শিক্ষার্থীরা পাস করে ইঞ্জিনিয়ারদের তীর্থস্থান এমআইটি’র মতো প্রতিষ্ঠানে খুব সহজেই মাস্টার্স ও পিএইচডিতে ভর্তি হতে পারবেন।
ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, টেক্সটাইল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের অধীনে টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগটি চালু করার জন্য ইউজিসি থেকে আরও তিন বছর আগে অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। একটি প্রকল্পের অধীনে বিভাগটির জন্য প্রায় ২৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। তবে নানা জটিলতায় এতদিন বিভাগটি চালু করা সম্ভব হয়নি।
সব জটিলতা কাটিয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিভাগটি চালু করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ জন্য ইউজিসি থেকে তিনজন প্রভাষক, একজন সহযোগী অধ্যাপক এবং একজন ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট নিয়োগের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। সহযোগী অধ্যাপক নিয়োগের জন্য দু’বছর আগেই সার্কুলার দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসন খুব শিগগিরই প্রভাষক এবং ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট নিয়োগের জন্য সার্কুলার দেবে।
ক্লাসরুম এবং শিক্ষক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সেটি চালু হলে ক্লাসরুম সংকট দূর হবে। আর ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালার কারণে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছি। তবে বুটেক্স প্রশাসন খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান করে ফেলবে।