১৫ অক্টোবর ২০২৪, ২১:৫৫

উপাচার্যের কক্ষে মিললো আন্দোলনের পক্ষে শিক্ষকদের পোস্টের স্ক্রিনশট

  © টিডিসি ফটো

‘আমার ছাত্র মরলো কেন? জবাব চাই, বিচার চাই...’ — নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ছাত্রহত্যার ঘটনায় বিচার চেয়ে এই পোস্টটি করেছিলেন জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেফমুবিপ্রবি) ফিশারিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম। আর এতেই যেন গা চমচমিয়ে উঠলো পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং ছাত্রলীগ নেতাদের। 

গত জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এতে ছাত্র-জনতা নিহত হতে থাকলে তা রূপ নেয় সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থানে। এ আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বশেফমুবিপ্রবিতেও কিছু শিক্ষক এ আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। নজরদারির উদ্দেশ্যে সংগৃহীত এসব শিক্ষকদের পোস্ট এবং কমেন্টের প্রিন্ট করা স্ক্রিনশটগুলো সম্প্রতি উপাচার্যের কক্ষে একটি খামভর্তি অবস্থায় পাওয়া গেছে। 

শুধু সাইফুল ইসলাম-ই নন, আরও সাবেক ট্রেজারার, কয়েকজন শিক্ষকের স্ট্যাটাস ও কমেন্টের স্ক্রিনশট জমা দিয়েছেন তারা। সেখানে থাকা স্ক্রিনশটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো: সাইফুল ইসলামের। তিনি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিকের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন।

১০ পাতার প্রিন্ট করা পোস্ট ও কমেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। কিছু শিক্ষক ও ট্রেজারের নাম হাইলাইটার কলম দিয়ে মার্ক করা রয়েছে। সেখানে থাকা অধিকাংশ পোস্ট ও কমেন্টগুলো করা হয়েছিল ৩রা আগস্ট বা তারও আগে এবং প্রিন্ট করা স্ক্রিনশটগুলোর বেশিরভাগই ৪ই আগস্টে নেওয়া হয়েছে এবং সেদিনই উপাচার্যের কক্ষে জমা দেওয়া হয়েছে। কেননা, ৫ই আগস্ট থেকে উপাচার্যের কক্ষ তালাবদ্ধ ছিল। 

ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ আরিফুল হকের বেশ কয়েকটি স্ক্রিনশটও সেখানে ছিল। তার পোস্টগুলোর মধ্যে একটি পোস্টে কোরআনের আয়াত এবং আরেকটিতে শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর শোক প্রকাশ করে লেখেন, “আমরা শিক্ষকরা, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অভিভাবক হিসেবে পরিচিত সে শিক্ষকরাই  যখন নিজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, সে আবার কীসের অভিভাবক। এ লজ্জা আমাদের, মেরুদণ্ডহীন শিক্ষকদের। আমি শিক্ষক হিসেবে বাকরুদ্ধ, লজ্জিত,ব্যথিত।”

স্ক্রিনশটগুলোতে ট্রেজারার মোহাম্মদ আব্দুল মাননানের দুটি ও সমাজ কর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আল মামুন সরকারের একটি কমেন্ট রয়েছে। এছাড়াও ওসব স্ক্রিনশটগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ, বর্তমান শিক্ষার্থী তাবাসসুম রাফি এবং মামুনুর রশিদসহ আরও বেশ কয়েক জনের কমেন্ট দেখা যায়। 

কীভাবে উপাচার্যের কক্ষে এগুলো পাওয়া গেল তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, সরকার যেকোনো সময় উপাচার্য নিয়োগ দিতে পারে। তাই কক্ষটি তার ব্যবহারের উপযোগী করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। এবং সাবেক উপাচার্যের ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র ছিল তা গোছাতে গিয়ে তার খাস কামরায় কয়েকটি খাম পাওয়া যায়। এর বেশিরভাগই নষ্ট কাগজপত্র। সেখানে পাওয়া একটি খাম খুললে একজন শিক্ষকদের ফেসবুক পোস্ট ও কমেন্টের স্ক্রিনশট প্রিন্ট করে মার্কার দিয়ে মার্ক করা। তখন বিষয়টি অফিসের ঊর্ধ্বতনদের জানানো হয়।

এ বিষয় জানতে সদ্য পদত্যাগ করা উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো: কামরুল আলম খানকে বারবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

বর্তমানে আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক মো: সাইফুল ইসলাম এ বিষয় বলেন, গত ৮ অক্টোবর উপাচার্যের কক্ষ পরিষ্কার করার সময় একটি খামে জুলাই-আগস্ট মাসে শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে করা কয়েকটি পোস্টের স্ক্রিনশট ছিল। এই ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রকাশ। প্রতিটি শিক্ষকদের মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, চাকরিচ্যুত করা বা অন্য কোন ক্ষতি করার চিন্তা থেকেই এগুলো কেউ করেছে। এই আন্দোলন সফল না হলে যেমন অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো না তেমনই যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী অনলাইন বা অফলাইনে আন্দোলন করেছে তাদের ক্ষেত্রেও এমন কিছুই হতো। নিয়মিত উপাচার্য আসার পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে।

বর্তমানে পিএইচডি করতে ওমানে অবস্থানরত শিক্ষক সৈয়দ আরিফুল হক মুঠোফোনে জানান, শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বললে সেটি কোট করে উপাচার্যের কক্ষে দেওয়া অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার দাবি করছি।

স্ক্রিনশটে থাকা মন্তব্য থাকা সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক আল-মামুন সরকার বলেন, যারা এটি করেছে, তারা একটি গর্হিত কাজ করেছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বৈরাচারী সরকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এমন কাজ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ক্ষেত্রে এমন কাজের জন্য তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরাও চাই এখানে তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।