এলসেভিয়ারের বিশ্বসেরা দুই শতাংশ গবেষকদের তালিকায় চুয়েটের তিন শিক্ষক
- চুয়েট প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২১ PM , আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৭ PM
বিশ্বের শীর্ষ দুই শতাংশ গবেষকের তালিকায় স্থান পেয়েছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) তিন জন শিক্ষক। গত ১৬ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক বিশ্বের প্রথম সারির চিকিৎসা ও বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশনা সংস্থা ‘এলসেভিয়ার’ যৌথভাবে এ তালিকা প্রকাশ করেছে। তিনজনই তাদের গত এক বছরের অসাধারণ গবেষণা কর্মের জন্য এ তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
গবেষকেরা হলেন- যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল ভূঞা, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুমিত মজুমদার ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আশরাফ আলী।
এ তালিকায় দুটি ধাপে সেরা গবেষক নির্ধারণ করা হয়। এর একটি হল পুরো পেশাগত জীবনের ওপর। আরেকটি শুধু এক বছরের গবেষণা কর্মের ওপর। বিজ্ঞানীদের প্রকাশনার মান, এইচ-ইনডেক্স, সাইটেশন ও অন্যান্য সূচক বিশ্লেষণ করে তালিকাটি প্রস্তুত করা হয়। ২২টি বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র এবং ১৭৪টি উপক্ষেত্র বিবেচনা করে স্ট্যান্ডার্ড সায়েন্স-মেট্রিক্স শ্রেণীবিভাগ অনুযায়ী মোট ২ লাখ ২৩ হাজার ১৫৩ জন গবেষককে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল ভূঞা ২০০৩ সালে চুয়েট থেকে যন্ত্রকৌশল বিভাগে স্নাতক এবং ২০০৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে একই বিভাগে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি স্কুল থেকে ডিজেল ইঞ্জিনের বিকল্প জ্বালানি হিসাবে ২য় প্রজন্মের বায়োডিজেল বিশেষত নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি অস্ট্রেলিয়াতে ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে গবেষণা করেছেন।
তার গবেষণামূলক আগ্রহের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি, বিকল্প জ্বালানি, শক্তি রূপান্তর, তাপ স্থানান্তর বৃদ্ধি, এবং তাপীয়-তরল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি এ পর্যন্ত শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক জার্নাল ও কনফারেন্সে ৮৫ টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত করেছেন। গুগল স্কলারে তার সাইটেশন (উদ্ধৃতি) সংখ্যা ৪০১৬, এইচ-সূচকের সংখ্যা ৩১ এবং আই ১০-সূচকের সংখ্যা হচ্ছে ৪০। ওয়েব অফ সায়েন্স তার গবেষণা প্রবন্ধগুলোকে খুব বেশি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত ক্যাটাগরিতে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। অধিকন্তু, গবেষণা কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি গত তিনবারও বিশ্বসেরা দুই শতাংশ গবেষণা বিজ্ঞানীদের তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন।
সুমিত মজুমদার কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ ও কম্পিউটার কৌশল বিষয়ে পিএইচডি এবং এম.এ.এসসি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার আগে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তিনি বর্তমানে মালয়েশিয়ার আইএনটিআই আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ফেলো হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি, তিনি ভ্রূণের হৃদস্পন্দনের নিরবচ্ছিন্ন পরিমাপ- বিষয়ক গবেষণা প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে তিন বছরের জন্য গবেষণা অনুদান পেয়েছেন।
তার গবেষণার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে পরিধানযোগ্য বায়োসেন্সর, বায়োমেডিকেল ইলেকট্রনিক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক প্রযুক্তি এবং স্মার্ট টেক্সটাইল। তিনি এ পর্যন্ত ২০ টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। গুগল স্কলারে তার সাইটেশন (উদ্ধৃতি) সংখ্যা ৩১৫০, এইচ-সূচকের সংখ্যা ১২ এবং আই ১০-সূচকের সংখ্যা হচ্ছে ১৫। গবেষণা কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি গত দুইবারের মতো এবারও শীর্ষ দুই শতাংশ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন।
মো. আশরাফ আলী পদার্থবিজ্ঞানের কনডেন্সড ম্যাটার শাখায় স্নাতকোত্তর, এমফিল এবং পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। তিনি বর্তমানে দ্য ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্সেস (TWAS) এর অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত অ্যাডভান্সড কম্পিউটেশনাল ম্যাটেরিয়ালস গবেষণা ল্যাবরেটরিতে প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি এ পর্যন্ত ৯৩ টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন।
বিভিন্ন স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক জার্নালের (৫২ টি জার্নাল) পিয়ার রিভিউয়ার হিসেবে তার উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। গুগল স্কলারে তাঁর সাইটেশন (উদ্ধৃতি) সংখ্যা ২৪০১, এইচ-সূচকের সংখ্যা ৩০ এবং আই ১০-সূচকের সংখ্যা হচ্ছে ৫৫। ২০২৩ সালে তিনি ভৌত বিজ্ঞান বিভাগে জুনিয়র গ্রুপে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি থেকে স্বর্ণপদক পান এবং ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে চুয়েটের সেরা গবেষণা ও প্রকাশনা পুরস্কার পেয়েছেন।
এ প্রাপ্তির বিষয়ে জানতে তাদের তিনজনের সাথেই কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল ভূঞা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্বের শীর্ষ গবেষকদের তালিকায় স্থান পাওয়া আমার নিজের পাশাপাশি চুয়েটের জন্যও অনেক সম্মানের। এমন জায়গায় চুয়েটের প্রতিনিধিত্ব করতে পারা অবশ্যই আনন্দের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অধিকতর গবেষণার মাধ্যমে চুয়েটকে আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আশা করি আমাদের এমন অর্জন ভবিষ্যতে চুয়েটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আরো আগ্রহী করে তুলবে।
এ অর্জন প্রসঙ্গে সুমিত মজুমদার বলেন, বিশ্ব সেরাদের তালিকায় স্থান পাওয়া বেশ আনন্দের, বিশেষ করে যেখানে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। একজন গবেষকের প্রকৃত মূল্যায়ন হয় তাঁর কাজের মান দিয়ে। বর্তমানে গবেষণার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণা কাজের মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যায়। বর্তমানে চুয়েটের অনেক শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ভালো মানের গবেষণা করছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় চুয়েট বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
এ বিষয়ে মো. আশরাফ আলী জানান, সেরাদের তালিকায় স্থান পাওয়া সবসময়ই গর্বের। এরকম স্বীকৃতি গবেষকদের গবেষণায় আরো উৎসাহিত করবে বলে আমি মনে করি। এ তালিকাটি মূলত গবেষণাক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী বিজ্ঞানীদের তালিকা (কিন্তু সেরা গবেষকদের তালিকা নয়), যেটা প্রধানত স্কুপাস (Scopus) কর্তৃক প্রদত্ত উদ্ধৃতি বা সাইটেশন সংখ্যার উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় অনেক সময় ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়।
গবেষণার বিষয়বস্তুর ওপর সাইটেশন সংখ্যা বেশী নির্ভর করে। যেমন- বাংলাদেশে আমার চেয়ে অনেক ভাল মানের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষক আছেন। কিন্তু তাদের সাইটেশন সংখ্যা কম হওয়ার কারণে তারা এই তালিকায় স্থান পান নাই।
আবার অনেকের মৌলিক গবেষণা খুব ভাল না থাকলেও, শুধুমাত্র কিছু রিভিউ পেপার থাকার কারণে সাইটেশনের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এই ধরনের তালিকায় সহজেই স্থান পেয়ে যায়। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন গবেষণা ক্ষেত্রে শুধু সাইটেশন সংখ্যার ভিত্তিতে একজনের সাথে অন্যজনের তুলনা করা কঠিন। তবে এ তালিকা প্রস্তুত করতে যে বিষয় গুলো বিবেচনা করা হয়েছে, তাঁর ভিত্তিতে তুলনা করার ফলে পদ্ধতিগত ত্রুটি কিছুটা কমেছে।
তিনি আরো বলেন, অন্যদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতিটা প্রতিষ্ঠান যদি এমন তালিকায় স্থান প্রাপ্তদের সম্মানিত করে, তবে অন্যরা যেমন গবেষণায় উৎসাহিত হবেন, তেমনি প্রতিষ্ঠানও লাভবান হবে। আশা করি চুয়েটের অনেকেই ভবিষ্যতে এ ধরনের তালিকায় স্থান পাবেন এবং চুয়েট এগিয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সাল থেকে তালিকাটি যৌথভাবে প্রকাশ করছে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা সংস্থা এলসেভিয়ার। এবার সপ্তম বারের মতো তাঁরা এ তালিকা প্রকাশ করেছে। এ বছর বাংলাদেশের ২০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের ২০৫ জন গবেষক এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন। পুরো ক্যারিয়ারে গবেষণার মান; সাইটেশন, সাম্প্রতিক বছরের গবেষণা ও নির্দিষ্ট ফিল্ডে অবদান রাখার কারণে তাদেরকে এ স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।