বুয়ার নামেও ভুয়া বিল বুটেক্স ভিসির, নানা অনিয়মসহ অভিযোগের পাহাড়
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) ভিসি বাংলোতে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল অ্যাটেনডেন্ট (বুয়া)। তবে এর বিপরীতে প্রতিমাসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ১৭ হাজার ২৫০ টাকা। সাড়ে ৫ কোটি টাকার যন্ত্র কেনা হলেও বিল তোলা হয়েছে ৩৩ লাখ টাকা বেশি। এমন অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বেলালের বিরুদ্ধে। তবে ক্ষমতার দাপটে এতদিন তা আড়ালেই থেকে গেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন এসব দুর্নীতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন শিক্ষকদের অনেকে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর একের এক সামনে আসছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর। এ তালিকায় এবার যুক্ত হলেন বুটেক্স উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বেলালের নাম। আওয়ামীপন্থী এ ভিসির বিরুদ্ধে গবেষণায় চুরি, দলীয় লেজুড়বৃত্তিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করার অভিযোগও রয়েছে।
কয়েকজন শিক্ষক কর্মচারীর অভিযোগ, ফফার্স (ফরহাদ, ফাতেমা ফায়েজ, রিয়াজ, আব্বাস, সাঈদজ্জামান) বাহিনী গঠনের মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দমন-পীড়ন, নিয়োগ বাণিজ্যসহ অনেক অপকর্মে জড়ানো ভিসি নিজেকে আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচয় দিতেও গর্ববোধ করেন। এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য-উপাত্তও দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে।
মেশিনারী ক্রয় ও স্থাপনে দুর্নীতি
চলতি বছরের শুরুতে মেশিনারি ক্রয় ও স্থাপনে ব্যয় হওয়া অর্থের অডিটে দেখা যায়, মেশিনারি ক্রয় বাবদ ভিসি ৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকার বিল করেছেন। কিন্তু মেশিন ক্রয় করা হয়নি। আবার কোনো নথিও বিলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া মেশিন স্থাপনে ৪০ লাখ টাকার বিল করা হয়েছে, যা বিল হিসেবে ধরার কথা নয়। মেশিন ক্রয় বাবদ পাঁচ কোটি ৪৭ লাখ টাকার মধ্যেই এ বিলও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নন-ওভেন মেশিন ক্রয়ে অনিয়ম
বুটেক্সের ভিসি ড. আলিমুজ্জামান বেলাল ফেব্রিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নন-ওভেন মেশিন ক্রয় ও স্থাপনেও দূর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অডিটের কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পিনটেক্স টেকনোলজি লিমিটেডকে কাজ দেওয়ার শর্তে ২০১৯ সালে তাদের অর্থায়নে পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে চীন ভ্রমণ করেছেন ভিসি। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ ও নন-ওভেন মেশিন এম্পিয়ার লাইন টেনে নতুন ডিবি বোর্ড স্থাপনের নামে অতিরিক্ত ৩৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন কোম্পানিকে। সব মিলিয়ে সাড়ে ৫ কোটি টাকার মেশিনটি সচল করতে ড. বেলাল খরচ করেন ৫ কোটি ৮০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ নিয়ে অডিটে আপত্তি জানানো হয়।
গবেষণায় চুরি
ভিসি নিয়োগের আগেই গবেষণা চুরির অভিযোগ ওঠে ভিসি বেলালের বিপক্ষে। কয়েকটি গণমাধ্যমে সে সংবাদও প্রকাশ পায়। তবে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিদেশি লেখকের বই থেকে হুবহু কপি করে সেটা নিজের নামে চালিয়ে কয়েক হাজার বই বিক্রি করেছেন ভিসি বেলাল।
বাসা বরাদ্দে অনিয়ম
নিয়োগ পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক বাসা বরাদ্দেও অনিয়ম করেছেন ভিসি বেলাল। নিজের পছন্দমত লোককে বাসা পাইয়ে দেওয়ার জন্য বাসা বরাদ্দ কমিটি ও কমিটির সভাপতিকে অন্যায় প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাছাড়া সিনিয়র-জুনিয়র তোয়াক্কা না করে নিজের খেয়াল খুশিমতো বাসা বরাদ্দ দিয়েছেন তিনি।
ছাত্রলীগকে বিশেষ সুবিধা
দায়িত্ব নেওয়ার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বুটেক্সের টেন্ডার ও কেনাকাটার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেন ভিসি। নিজের বাসভবন মেরামত থেকে শুরু করে টিস্যু পেপার সরবরাহ- সবকিছুই হতো ছাত্রলীগের সভাপতি তরিকুল ইসলাম টিপু ও আব্দুল্লাহ জয়ের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব টেন্ডারে আগে থেকে তথ্য দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বাগিয়ে নিতেন বুটেক্সের কোটি কোটি টাকার টেন্ডারও। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগ সভাপতি টিপুর কক্ষ থেকে টেন্ডারকৃত পণ্যের প্রকৃত মূল্য সম্বলিত প্রচুর কাগজ পাওয়া গেছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ছাত্রলীগের সভাপতি তরিকুল ইসলাম টিপুর মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আর ক্যাম্পাসে আসেননি।
কাজের বুয়ার নামে ভুয়া বিল
কাজের বুয়ার নামে প্রায় ১৪ মাস ভুয়া বিল তুলে নেন ভিসি বেলাল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভিসি বাংলোতে এক নারীকে অ্যাটেনডেন্ট (বুয়া) হিসেবে মাসিক ৫ হাজার টাকায় নিয়োগ দেন তিনি। কিন্তু এর বিপরীতে প্রতিমাসে বুটেক্স থেকে তুলে নেন ১৭ হাজার ২৫০ টাকা। ১৬ মাসে প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার উত্তোলন করেন তিনি। এ ছাড়া বাসার অ্যাটেনডেন্ট ও কুকের বিপরীতে ভিসি বেলাল প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা তুলে নেন। আগে কাজ করা একজন বুয়া ৫ হাজার টাকা করে পেতেন বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কাছে স্বীকার করেছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা মাসে ১৭ হাজার ২৫০ টাকা বিল তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে বুটেক্সের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. জুলহাসউদ্দিন বলেন, ‘নৈতিকভাবে ভিসি বেলাল অত্যন্ত নিচু মানসিকতার। তাঁর এসব অপকর্ম বুটেক্সের সম্মানহানি করছে। দ্রুততম সময়ে তাঁর শর্তহীন পদত্যাগ করা উচিত।’
এদিকে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ২ কোটি টাকা দিয়ে ভিসি নিয়োগ দিতেন বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। বুটেক্স ভিসির বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তা। এর আগে ছাত্রলীগের সভাপতি তরিকুল ইসলাম টিপু ও সাধারণ সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম মিরান অভিযোগ করেন, ভিসি বেলাল দায়িত্ব নেওয়ার পর সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসিমউদ্দিন হল শাখা ছাত্রলীগ নেতা ও তার অলিখিত পিএ মো. নাসিরকে বুটেক্সের শহীদ আজিজ হলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে একটি টেন্ডার পাওয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগও করেন তারা।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অনিয়ম ও দুর্নীতির আতুড়ঘরে পরিণত করেছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পরও তিনি কীভাবে টিকে আছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকদের একাংশ। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আরেক অংশ চান, তিনি তার মেয়াদ শেষ করুক। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে।
আরো পড়ুন: উপাচার্যসহ শীর্ষ পদে নিয়োগ: ৪ শিক্ষকের নাম পাঠালেন শিক্ষা উপদেষ্টার ভাগ্নি
অপরদিকে সম্প্রতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অডিও ক্লিপ এসেছে। অডিওটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক অনুষ্ঠানের। এতে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘যদি দলের কঠিন সময়ে আমরা শেখ হাসিনার পাশে না থাকতে পারি, তাহলে সেটা বেইমানি হয়ে যাবে। বুটেক্স শেখ হাসিনার ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘যার কারণে আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছি, যার কারণে আমরা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি, যিনি আমাদের রিক্রুটমেন্টের সুযোগ দিয়েছেন, আমরা যেন তার ঋণ শোধ করার চেষ্টা করি।’ অডিওতে তিনি আরও বলেন, ‘যতদিন শেখ হাসিনা আছে, আমরা আছি, আমাদের দল আছে- নিশ্চয়ই আমরা কোনোভাবে বাংলাদেশকে জামায়াত-বিএনপির হাতে তুলে দিতে পারি না।’
বক্তব্যের এক পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু মেধা নয়, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিতে বিশ্বাসীদের নিয়োগের কথা বলেন অডিওর ব্যক্তিটি। এ ছাড়া যারা বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্দোলনের নামে অস্থিতিশীল করছে, তাদেরকে বেইমান বলে অভিহিত করে তাদের ক্ষমা না করার কথাও বলেছেন। সভায় অন্য একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা চাই, বেলাল সাহেবের দ্বারা এখানে আওয়ামী লীগের বীজ বপন হোক। আমরা চাই শিক্ষক নিয়োগ মেধার ভিত্তিতেই হবে। তবে সেটা দলকেন্দ্রিক এবং এর কোনো বিকল্প নেই।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বুটেক্স ভিসি অধ্যাপক ড. শাহ্ আলিমুজ্জামান বেলালের বক্তব্য জানতে কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।